সমাজে বরাবরই নারীকে শারীরিকও মানসিক ভাবে দুর্বল হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। নারী ও পুরুষের দৈহিক গঠনে পার্থক্য থাকাকে দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখা দরকার। আর মানসিকভাবে নারীকে দুর্বল ভাবা নিজের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে মাত্র।
ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের মানসিক শক্তি, বহুমুখী কাজের দক্ষতা এবং একই সঙ্গে ঘর ও বাইরের সব কাজ সামলে নেওয়ার ক্ষমতার কথা।
কথা হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ’য়ের কর্মরত শিক্ষক ইমিল্ডা গমেজের সঙ্গে। ব্রেইন স্ট্রোক করে শরীরের ডানপাশ অবশ হয়ে গেছে তার স্বামীর, দুই বছরের কন্যা সন্তানের জননী তিনি। বিয়ের দুবছর পরেই স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতায় তিনি বেশ ভেঙে পড়েন। একটা পর্যায়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ধরতে হয় সংসারের হাল। বাইরে কাজের চাপ, ঘরে অসুস্থ স্বামীর সেবা করা পাশাপাশি ছোট সন্তানের ঠিকঠাক পরিচর্যা একা হাতেই সামলাতে হচ্ছে তাকে।
তিনি বলেন, “কখনও একটা কাজের জন্য অন্য কাজের ক্ষতি হতে দেই না। বাইরে কাজ করার সময় তা যেন নিখুঁত হয় সেদিকে মনযোগ দেই। অন্য দিকে বাসায় এসে স্বামী-সন্তানের জন্য কাজ করার সময় যেন বাইরের কাজের চাপ আমাকে বিব্রত না করে সেদিকেও খেয়াল রাখি। ঘরের সব কাজ শেষে চেষ্টা করি মেয়ের সঙ্গে আদর্শ কিছু সময় কাটাতে। ছোট থেকেই যেন সে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেদিকে যতটা সম্ভব খেয়াল রাখি।”
যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে স্বামী তাকে সাহস যোগায় বলে জানান তিনি।
অসুস্থ স্বামীর মুখের দিকে তাকালেই তার মনে হয় “আমাকে পারতেই হবে।”
“তাছাড়া কোনো কঠিন কাজ বা পরিস্থিতি সামনে আসলে ‘এটা তুমি পারবে’ স্বামীর মুখের এই কথাটা তাকে অনেক সাহস যোগায় আমাকে।”
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মমতা গমেজের কাছে প্রশ্ন ছিল ব্যবসা ও সংসার সামলানোর প্রসঙ্গে।
তিনি বলেন, “সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই এই প্রচেষ্টার শুরু। তাই বলে ব্যবসা সামলাতে গিয়ে সন্তান পরিচর্যায় কোনো অবহেলা করি না। যার জন্য এত পরিশ্রম সেই যদি ঠিক মতো মানুষ না হয় তাহলে আর লাভ তী? তাই সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করে পাশাপাশি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।”
তার স্বামীও তাকে এই কাজে সাহায্য করেন। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে রাতে স্ত্রীর ব্যবসার দেখাশুনা করেন। যে কোনো প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করেন।
নারী দিবস নিয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্বামী স্ত্রীর যৌথ প্রচেষ্টায় সংসার সুখের হয়। বছরে কেবল একটা দিন নারীর অধিকার বা মর্যাদার জন্য বড় বড় কথা না বলে সারা বছরই তার অনুশীলন চালিয়ে গেলেই প্রকৃতভাবে নারীকে সম্মান দেখানো হবে। আর সবাইকে এই শিক্ষা নিতে হবে পরিবার থেকেই।”
শিওরক্যাশ’য়ে কর্মরত তিথি সরকারের কাছে প্রশ্ন ছিল- অবিবাহিত চাকুরিজীবী নারী হিসেবে ঘরে বাইরে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়?
উত্তরে বলেন, “হুম, নারীরা এখন অনেকটাই এগিয়েছে। আগে যেমন ঘর থেকে বের হওয়া বা চাকুরি করার বিষয়টা খুব একটা গ্রহণযোগ্য ছিল না, এখন তেমন না হলেও একেবারেই যে কোনো পার্থক্য নেই তা কিন্তু নয়। কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই নারীদের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। অথবা কোনো দায়িত্ব দেওয়ার পরেও তা ঠিক মতো করতে পারবে কনা সেটা নিয়ে দ্বিধা প্রকাশ করে। আর অবিবাহিত নারীদেরতো ভিন্ন জ্বালা।”
“অফিস বা বাড়ি সব জায়গায়- এখনও বিয়ে করেন না কেনো? বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ আছে না কি ঠিক করা, না থাকলে বলেন আমরা খুঁজে দেই অথবা নানান ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনতে হয়। প্রাথমিক দৃষ্টিতে কথাগুলোকে দোষের মনে না হলেও এই ধরনের কথা যে মানসিক চাপের সৃষ্টি করে তা অনেকেই বোঝেন না। মানসিক অস্থিরতা নিয়ে ঠিকভাবে কাজ করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ।” বললেন তিথি।
তার মতে, “বিয়েটা একটা ‘চয়েজ’। যখন কেউ মনে করবে, সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত তখনই বিয়ে করা উচিত। পরিবার বা মানুষের কথার চাপে পড়ে নয়।”
তিনি আরও বলেন, “বিয়ের জন্য বাবা মায়ের নানান হুমকি, মানসিক চাপ সৃষ্টি আবার মেয়ের নিজের পাত্র নিজে পছন্দ করা বিষয়টাকে ঠিকভাবে গ্রহণ না করা ইত্যাদি থেকে বেড়িয়ে আসা উচিত। সন্তান যখন ছোট থাকে তখন তাকে ঠিকঠাক শিক্ষা দেওয়া এবং বড় হওয়ার পরে তার বুদ্ধি বিবেচনার উপর ভরসা রাখা উচিত বলে মনে করি আমি।”
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শিমু লতা মৃধা’র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এই যুগেও নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।
তিনি বলেন, “সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় থাকা দরকার, সেটা এখনও বলে দিতে হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নড়বড়ে। তাছাড়া অনেক নারীই নিজের অবস্থান বা অধিকার সম্পর্কে জানেন না। অনেকেই সমঅধিকার বলে লাফালাফি করেন। কথাটা হওয়া উচিত ছিল ‘সাম্যতা”।
“পুরুষের সমোধিকার না চেয়ে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক অধিকার আদায়ের জন্য এই নারী দিবসের সূচনা। অনেকের কাছেই বিষয়টা অপরিষ্কার।” বললেন তিনি।
“সমাজে ছোট থেকেই ছেলে আর মেয়েকে আলাদাভাবে মানুষ করা হয়, শিশুকাল থেকেই মেয়েদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ‘মেয়েমানুষ’ তকমা। নারী হয়ে কোনো কঠিন কাজে গেলে এবং তাতে বিফল হলে শুনতে হয় ‘মেয়েমানুষের কাজ না এটা’ আবার কর্মক্ষেত্রে কাজে সামান্য ত্রুটিকে ধরা হয় মেয়ে বলেই কাজটা যথাযথভাবে পারেনি, ইত্যাদি আরও অনেককিছু।”
“এই গেল সমাজ ও অফিসের কথা। বাড়িতেও তো এই জ্বালা কম নয়। মেয়ে শিশু অগোছালো হলে শুনতে হবে ‘মেয়ে হয়ে এত অগোছালো হলে কেমনে চলবে?’ আর ছেলে শিশু একই কাজ করলে, খুব একটা উচ্চবাচ্য না করে মা অথবা বোন তা গুছিয়ে রাখে- এটা একটা ইঙ্গিত মাত্র।”
“পরিবারই সমাজের মূল। পরিবার থেকেই সন্তানদের নিজের কাজ নিজে করা শেখানো উচিত। ছেলে-মেয়ের কাজ আলাদা করে না দিয়ে একসঙ্গে কাজ করা এবং নিজের কাজ নিজে করা শেখাতে হবে। সমতা আসবে তখনই। ছেলে ও মেয়েকে একই সুবিধায় বড় করে তারপর তাদের দক্ষতা যাচাই করতে হবে। বড় করার ধরনই যদি হয় আলাদা তাহলে তাদের দক্ষতা এক হবে কীভাবে আর তারা একসঙ্গে মাঠেই বা নামবে কী করে?”
তিনি পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, পরিবারে মা-ই শিক্ষক, প্রতিটা মায়েরই উচিত ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য না করে তাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। মনে রাখবেন মানুষ ঘরে যা শিখে তার প্রতিফলন ঘটে বাইরে। ভাইয়কে বোনের প্রতি সম্মান করতে শেখান একই শিক্ষা দিন মেয়েকেও। তাহলে নারী পুরুষ একে অপরকে সম্মান করবে।”
মেয়েদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “নারী হিসেবে সবকিছুতে সুযোগ নিতে চাওয়াটাও অসম্মানের। এখানে নীতির প্রশ্ন চলে আসে। নিজেকের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা তারপর নিজের প্রাপ্য আদায়ের চেষ্টা করা উচিত। নারী বলে সবক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে যেও না।”
বাসে নারীদের জন্য সিট বরাদ্দ থাকে ঠিক। তবে একজন সুস্থ সবল নারী হয়ে বসে না যেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অসুস্থ কোনো বৃদ্ধকে বসতে দিয়ে নিজের পরিবারের দেওয়া সুশিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
সমাজে যার যার অবস্থান থেকে সঠিক কাজ করা, মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা ও অন্যকে সম্মান করার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। তখন আর ঘটা করে নারী দিবস পালন করা আর পুরুষ দিবস নেই কেনো এই নিয়ে হাহাকার করা লাগবে না।
আর ক্ষেত্র বিশেষে নারীর বাড়তি সুবিধা নিয়েও অনেক পুরুষের মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের সমাধান হবে।