দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে সব দলের আস্থা অর্জনের জন্য নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের প্রতি আহ্বান এসেছে বিশিষ্টজনদের সংলাপ থেকে।
ইসি যে নিরপেক্ষ, সেটা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আপস না করে প্রয়োজনে পদত্যাগ করতেও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নতুন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর যে ধারাবাহিক সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেন বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় ১৯ জন।
প্রথম সংলাপের মতো দ্বিতীয় সংলাপেও আমন্ত্রিত অধিকাংশ ব্যক্তিই উপস্থিত হননি।
সংলাপে যারা অংশ নেন, তারা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরানো, ইভিএমে ব্যবহার না করা, দলীয় সরকারের সময় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করা, নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার করতে না দেওয়ার পরামর্শ দেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে সাহসী হতে বলেন তারা।
সংলাপে লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিনহা এম এ সাঈদ, বলেন, “ইসির এত সংলাপ করার মানে হচ্ছে এখানে সঙ্কট রয়েছে। আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার।”
“নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে,” বলার পরই তিনি বলেন, “আমি আশাবাদী মানুষ।”
নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরন কেমন হবে, নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায়, সে বিষয়ে কাজ পরার পরামর্শ দেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্যে আইনে কোনো পরিবর্তন করা যায় কি না, তা চিহ্নিত করেন আপনারা।”
সরকারের অনুগত না থেকে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রয়োজনে ইস্তফা দেবেন। সব অংশীজন, ভোটার, আমরা আপনাদের পক্ষে আছি।”
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভান্তি স্বীকার কাজ এগিয়ে নিতে হবে।”
গত দুটি নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে তিনি বলেন, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভবপর নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ভোটের-আগে পরে ছয় মাস কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিৎ।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সঙ্কটে পড়েছে। প্রস্তাবিত সবার নাম প্রকাশ করেনি সার্চ কমিটি। এছাড়া কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জোনায়েদ সাকি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের নিবন্ধন দেওয়ারও অনুরোধ করেন তিনি।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাহসী পদক্ষেপ ও সত্য বলার পরামর্শ দিয়ে জাফরুল্লাহ বলেন, “এটি কঠিন সমস্যা, দেশের বিরাট একটি রাজনৈতিক দল বয়কট করে বেড়াচ্ছে। এটাতে সমস্যা। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না অনেকে বলেছেন।”
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “নির্বাচন ব্যবস্থাপনার উপর আস্থা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।”
মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে পেশাজীবীদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হয়।মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে পেশাজীবীদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হয়।
ইভিএমে আপত্তি
দেবপ্রিয় বলেন, “ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দূরে থাকা ভালো। ইভিএম নিয়ে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করতে দিতে পারে। ইভিএম ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা উচিৎ নয়।”
সিপিডির আরেক সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। একটি ভালো ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন দেবেন।”
লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না-তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।”
ফরাসউদ্দিনও বলেন, “ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলবো- ইভিএম ব্যবহার না করার জন্যে।”
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এল? ইভিএম নিয়ে এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে, তবে এটা না হওয়াই ভাল।”
সংলাপে আরও অংশ নেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও শামীম রেজা, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দীন আহমেদ, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, নিজেরা করির কো-অর্ডিনেটর খুশি কবির, বাংলাদেশ ইনডিজিনিয়াস পিপলস ফোরাম সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের (সিইউএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন, গভর্নেন্স অ্যান্ড রাইটস সেন্টারের সভাপতি জহুরুল আলম।
এই সংলাপে ৪০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাদের অর্ধেকই আসেননি।
‘৫০-৬০% গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই সফল হব’
সংলাপ শেষে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন ‘৫০-৬০%’ গ্রহণযোগ্য হলেই বড় সফলতা হবে।
“নির্বাচনটাকে যদি অবাধ, সুষ্ঠু করা যায়, তাহলে সেটা সকলের অংশগ্রহণে হয়, সেটা সফলতা হতে পারে। শতভাগ সফল হয়ত হবে না; কেউ কেউ বলেছেন, ৫০-৬০ শতাংশও যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে সেটাও বড় সফলতা।”
‘মোটা দাগে’ সবার মতামত তুলে ধরে সিইসি বলেন, ভোটাররা ভোট দিতে না পারলে, বাধা এলে, পোলিং অফিসারদের তাড়িয়ে দিলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না। নির্বাচনটা অসম প্রতিযোগিতা হয়ে যায়। ভোটে সহিংসতার ব্যাপকতা থাকলে ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
ভোটে সবাইকে আনা নিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “যারা ডিক্লেয়ার করে দিয়েছেন নির্বাচনে অংশ নেবেন না; কিন্তু তাদের অংশগ্রহণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কীভাবে আস্থায় আনা যায়, আমন্ত্রণ জানিয়ে ভদ্রভাবে আসার কথা বলে কিছুটা তাদের পরিবর্তন করা যায় কিনা।”
ইভিএম নিয়ে তিনি বলেন, “ইভিএমে কোনো অসুবিধা আছে কি না? অনেকে অভ্যস্ত নন। মেশিনের মাধ্যমে ভোটে কোনো ডিজিটাল কারচুপি হয় কি না, এটা আমাদেরকে দেখতে হবে। ইভিএমে ভালো দিক রয়েছে, দ্রুত গণনা হয়ে যায়।”
“ধর্মকে যেন নির্বাচনে কোনোভাবে উপজীব্যতা না পায়, নির্বাচনে এটাকে কাজে না লাগায় এটা অবশ্যই আমরা দেখব,” বলেন তিনি।
কমিশনের সাহসী হওয়ার সঙ্গে সততাও থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেন হাবিবুল আউয়াল।
সরকারি দলের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, “যে দল সরকারের থাকে তাদের কিছুটা বাড়তি এডভান্টেজ থাকে। কারণ, প্রশাসন, পুলিশ সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসি তাদের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে?
“আইনের কোনো অভাব নেই। কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে বাস্তব ঘাটতি রয়েছে। আমরা এনফোর্সমেন্টটা যেন ভালোভাবে করতে পারি, সেই চেষ্টা করব। এনফোর্সমেন্ট ক্যাপাসিটি আরও বাড়াতে পারলে তৃণমূলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হয়। তাহলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণ্ডগোল হবে না; আমরা অনুকূল পরিবেশ পাব।”