আন্দোলনের কথা বিএনপির যারা বলেছেন, কর্মসূচিতে তাদের সক্রিয়তা চেয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রোববার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে জোরাল কর্মসূচি না থাকা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান নিয়ে দলীয় নেতাদের মধ্য থেকে প্রশ্ন তোলার পর তা নিয়ে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার আগে খালেদা জিয়ার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে এই ঐক্য ধরে রাখার উপরও জোর দেন ফখরুল।
ফখরুল বলেন, “আজকে এখানে অনেকে অনেক কথা বলছেন। আমরা দেখেছি, নেত্রীর গ্রেপ্তারের পরে যখন আমরা কর্মসূচি দিয়েছি, কতজন এসেছেন, কতজন আসেননি। আমরা তো দেখেছি, কারা কারা সেই কর্মসূচির মধ্য থেকে আস্তে আস্তে চলে গেছেন। আমরা তো দেখেছি, এই নির্বাচনের মধ্যে কারা বেরিয়ে এসেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, কারা প্রতিবাদ করেননি।
“শুধু কথা বলে, শুধু একটা আবদ্ধ ঘরের মধ্যে নিরাপদ জায়গায় এসব কথা বলে আমরা সেই শত্রুকে (আওয়ামী লীগ) পরাজিত করতে পারব না।”
ফখরুল বলেন, “কথা সবাই বলতে পারেন, কিন্তু কাজ করতে হবে। কে কত জন আসছেন, না আসছেন, কে কতটুকু বিপ্লবের পথে যাচ্ছেন, বিদ্রোহের পথে যাচ্ছেন, সেই বিষয়গুলো অবশ্যই আপনাদের মানতে হবে।”
এ সময়ে নেতা-কর্মীদের আসন থেকে দুই-একজন কর্মী কথা বলতে চাইলে ফখরুল বলেন, “কে কথা বলছেন আসেন। মঞ্চে আসেন।”
ছাত্রদলের ঢাকা কলেজের একজন কর্মী উঠে মহাসচিবের কাছে এসে বলেন, “ঐক্যফ্রন্টের যে সর্বশেষ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, সেখানে ম্যাডামের মুক্তি চাওয়া হয়নি কেন?”
আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর এক ছাত্রদলকর্মীকে ডেকে তার কথা শোনেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
ফখরুল তার উত্তরে বলেন, “প্রশ্নই উঠে না। কে বলেছে একথা? প্রথম কর্মসূচি গেছে, মুক্তির কথা ছিলো। এখনও কর্মসূচি চলছে। এসব মিথ্যা কথা বলবে না।”
এরপর মাইকে দাঁড়িয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “কখনোই জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না। আমি যে কথা বার বার বলি, কিছু আমরা আছি, যারা জনগণকে বিভ্রান্ত করি, জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না, উচিৎ নয়। সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক যারা আছেন, তাদেরকে এসব উপলব্ধি করতে হবে।”
প্রশ্ন উঠলেও ঐক্যের পক্ষে ফখরুল
এই অনুষ্ঠানে ফখরুলের আগে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “কেন এই নির্বাচনে আমরা গেলাম। কথা ছিল, নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না, কিন্তু তা তো হল না। কথা ছিল, খালেদা জিয়া ছাড়া নির্বাচন হবে না, কিন্তু খালেদা জিয়া ছাড়া আমরা নির্বাচনে গেলাম।
“কেন আজও খালেদা জিয়া জেলে? কেন একটা দাবিও সরকার মানল না? কী কারণে এটা হলে? এর কারণ অবশ্যই বের করতে হবে। যদি বের করতে ব্যর্থ হই আবার ব্যর্থ হব। আমার অনেক প্রশ্ন আছে আজকে এখানে করব না। দলীয় মিটিংয়ে বলব।”
কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, “আমরা তাকে নেতা মানলাম। কেন, ফখরুল কী দোষ করেছিল? মহাসচিব ফখরুল, আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আমাদের তো অন্য কারও দরকার নেই। আমাদের কারও দরকার ছিলে না। আমরা যা পারি করব, না পারলে করব না। কিন্তু এটা কী হল? ঠাডা (বাজ) পড়লো সমগ্র জাতির উপর।”
ওবায়দুর রহমানের স্মরণসভায় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নাও ছিলেন
শাহ মোয়াজ্জেমের এই বক্তব্যের সময় কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিউট মিলনায়তনের এই আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব ফখরুলের মুখেও ছিল বিব্রতভাব।
শাহ মোয়াজ্জেমের পর বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে ফখরুল বলেন, “আজকে খুব সুপকিল্পিতভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে জনগণের ঐক্যকে ভেঙে ফেলার। যে ঐক্য তৈরি হয়েছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, জনগন যেভাবে নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছে এই স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগ সরকারকে, সেই ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।”
কারাবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আজকে বাংলাদেশে একটা গণতন্ত্রহীন অবস্থা বিরাজ করছে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা নির্বাচনকে আমাদের আন্দোলনের একটা হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। এটা বেছে নিয়েছিলাম আমাদের গণতন্ত্রের মাতা আমাদের দলের চেয়ারপারসন তারই নির্দেশে।
“আমাদের যে নির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়েছিল, সেখানে দেশনেত্রী পরিষ্কার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে গণতন্ত্রের পক্ষে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং এই স্বৈরাচারকে পরাজিত করবার জন্য সেই ঐক্যকে নিয়েই লড়াই করতে হবে।
“নির্বাচনে যাওয়ার পূর্বেও আমরা নেত্রীর সঙ্গে কারাগারে যোগাযোগ করেছি। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, নির্বাচনে যেতে হবে এবং ঐক্য গড়ে তুলতে হবে জনগণের মধ্যে। এমনকি নির্বাচনের পরেও তিনি এ্ নির্দেশই দিয়েছেন যে, এই ঐক্যকে ধরে রাখতে হবে।”
জেএসডির সভাপতি রব অনুষ্ঠানে বলেন, “সকল মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে যেমন জনগণ বের করে নিয়ে এসেছে, খালেদা জিয়াও সেভাবেই মুক্ত হবেন। আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হয়না। আমি বলি, আন্দোলন জমা থাকে। সকল আন্দোলন পুঞ্জীভুত হয়ে যখন বিস্ফোরিত হবে, সেদিন তারা ভেসে যাবে। হতাশ হওয়ার কিছু নাই।”
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না বলেন, “আমি আহ্বান জানাব, ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ়ভাবে লড়াই চালাতে হবে। তার বিকল্প নাই।”
দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, “স্পষ্ট করে বলতে চাই, শুধু আবেগ দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না।
“আজকে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এই ভয়ংকর ফ্যাসিবাদকে সরাতে হবে ক্ষমতা থেকে। ঐক্য ভেঙে গেলে আর কোনোদিন তাদের সরাতে পারবেন না। আজকে আমাদেরকে ছোট-খাটো সমস্যাকে বড় করে না দেখে ঐক্য অটুট রাখতে হবে।”
এরশাদ আমল থেকে বিএনপিকে ভেঙে ফেলার নানা ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, “কিন্তু কেউ সফল হয়নি। বহু চেষ্টা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বিএনপির একজন কর্মীকেও কেউ সরিয়ে নিতে পারেনি।
“অনেকে বলেন যে, বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি বলি, বিএনপি কোনোদিন নিঃশেষ হবে না। কারণ বিএনপি জনগণের দল, এই দেশের মাটির গন্ধ হচ্ছে বিএনপির রাজনীতি, এদেশের জনগণের শ্রমের যে ঘাম, সেটা হচ্ছে বিএনপির রাজনীতি।”
ড. কামালকে নিয়ে প্রশ্ন শাহ মোয়াজ্জেমের
বিএনপি নেতা কে এম ওবায়দুর রহমানের দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মরণে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় শাহ মোয়াজ্জেম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ও গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেনের রাজনৈতিক জীবনে নানা ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
কে এম ওবায়েদ, শাহ মোয়াজ্জেম ও কামাল তিনজনই একসঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগে, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওবায়েদ ও শাহ মোয়াজ্জেম উভয়ই মোশতাক আহমেদের সরকারে যোগ দিয়েছিলেন।
কে এম ওবায়েদ পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মহাসচিবও হয়েছিলেন। খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আলাদা বিএনপি গঠন করে টিকতে না পেরে পরে বিএনপিতে ফেরেন তিনি। অন্যদিকে শাহ মোয়াজ্জেম জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে দলটির মহাসচিব এবং এইচ এম এরশাদের সরকারে মন্ত্রী হন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি।
ওবায়েদ ও শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সরকারে থাকা কামাল হোসেন পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। দুই যুগ আগে আওয়ামী লীগ ছেড়ে গণফোরাম গঠন করেন তিনি। এবার নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে তিনি ঐক্য গড়েন।
ওবায়েদের স্মরণসভায় বক্তব্যে কামাল হোসেনের নাম না নিয়ে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, “আমি স্বাধীনতার ইতিহাস জানি। সেসময়ে কে যায় নাই ভারতে? আমরা সব চলে গেলাম। এনটায়ার কেবিনেট চলে গেল। গর্ভনর হাউজে (বর্তমানে বঙ্গভবন) ইয়াহিয়া খানের সাথে কথা বলার সময়ে যে ব্যক্তি ছিল সর্বক্ষণ (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে), সে গেল না।
“তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের একটা বই বেরিয়েছে রিসেন্টলি, সেটা আপনারা পড়বেন। সেটাতে লেখা আছে, তার যাওয়ার কথা ছিলে আমাদের সাথে, সে যায়নি। আমি নাম বলতে চাই না এই মুহুর্তে। ১৪ জুন পর্যন্ত ঢাকা থাকলেন, তারপর জিওসিকে টেলিফোন করে বললেন, আমাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দাও। পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার স্ত্রী একজন সিন্ধি।”
কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে নানা সন্দেহের কথা এখন আওয়ামী লীগ নেতারাও বলছেন। তবে তার ভাষ্য, একাত্তরে তিনি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, “আমরা তার (কামাল হোসেন) ইতিহাস জানি। বাংলাদেশের তার কোনোদিন কোনো আসন ছিল না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এক সময়ে সে (কামাল) বৃদ্ধ সাত্তার সাহেব (বিচারপতি আবদুস সাত্তার) আমার চাচাশ্বশুর দুঃসম্পর্কে, তার কাছে এক কোটি ভোটে হেরেছিল।”
ওবায়েদ স্মৃতি সংসদের এই আলোচনা অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, কলামনিস্ট মাহফুজউল্লাহ, ওবায়েদের মেয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বক্তব্য রাখেন।
ওবায়েদুর রহমান স্মৃতি সংসদের সভাপতি টি এম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করেন, পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সম্রাট।