মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বহীনতায় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে ৩৩৮টি উন্নয়ন প্রকল্প। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে এসব প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়।
কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদাসীনতার কারণে সময় বাড়ানো হয়নি। শেষ হয়েছে এমন প্রকল্পের ব্যাপারে ঘোষণাও দেওয়া হয়নি। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সংশোধনের সময় প্রকল্পগুলোর অনুকূলে অর্থছাড় বা ব্যয় বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি কিংবা সংশোধন ছাড়া কোনো খরচ করা যাবে না। গত ১ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠক থেকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কারণেও প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রলম্বিত হবে। এতে ব্যয় বাড়বে, যা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে অপচয়ের শঙ্কাও প্রবল হবে। এছাড়া যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় এসবের সুফলও বিলম্বিত হবে। তাদের মতে, বছরের পর বছর এমন আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ চললেও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা বা শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির নেই। ফলে সব সময় একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেমন-গত অর্থবছরেও এমন প্রকল্প ছিল ২৯৩টি। তুলনামূলক হিসাবে দেখা যায় চলতি বছরে এই হার বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব হচ্ছে বলে তারা মনে করেন। কাজেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ না রেখে যাদের কারণে বিলম্ব হচ্ছে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়ে তারা জোর দেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম সোমবার বলেন, কেন বছরের পর বছর এমন ঘটনা ঘটে চলছে সেটি বলা সম্ভব নয়। আমরা তো বারবার তাগাদা দিয়েই যাচ্ছি। এটা একটি জটিল বিষয় হওয়ায় মন্তব্য করাও কঠিন। তবে এজন্য দায়ী হচ্ছে প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার কাজ চলছে। প্রকল্পগুলোর ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা আছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।
সূত্র জানায়, অধিকাংশ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরের মধ্যেই। কিন্তু সময়মতো সংশোধন বা সমাপ্ত ঘোষণার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। ফলে এখন ‘স্টার’ (তারকা) চিহ্ন দিয়ে এসব প্রকল্প যুক্ত হওয়ার কথা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে। কিন্তু তার আগেই নতুন নির্দেশনা দেয় এনইসি। এর আওতাভুক্ত প্রকল্পের মধ্যে ১৩ বছর ধরে চলছে একটি। এছাড়া ১২ বছর ধরে চলমান আছে তিনটি, ১১ বছরের তিনটি এবং ১০ বছর ধরে চলছে তিনটি প্রকল্প। আরও আছে ৯ বছর ধরে চলমান আটটি প্রকল্প, আট বছর ধরে আটটি এবং সাত বছরের রয়েছে ২৮টি। গড়ে এসব প্রকল্প দুুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা এসব প্রকল্পের মধ্যে ছয় বছরের আছে ১৪টি প্রকল্প। এ ছাড়া পাঁচ বছরের ৬৩টি, চার বছরের ৭৯টি এবং তিন বছর ধরে চলছে ৪৯টি উন্নয়ন প্রকল্প। বাকি ৭৯টি প্রকল্প এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এটা চরম দায়িত্বহীনতা এবং গাফিলতির বহিঃপ্রকাশ। তবে এখন খতিয়ে দেখতে হবে এসব প্রকল্প কেন সময়মতো শেষ হলো না। আগামীতে কাজ শুরু হলে তা কবে নাগাদ শেষ হবে। যদি শেষ করা না হয় তাহলে কী ফলাফল আসবে। এর ভিত্তিতে মেয়াদ বৃদ্ধি বা সংশোধনের উদ্যাগ নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ না হলে প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার।
সূত্র জানায়, সংশোধিত এডিপিতে ‘স্টার’ চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে ৩৯টি। একই অবস্থানে আছে পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৩৯টি প্রকল্প। এ ছাড়া শিক্ষা খাতে আছে ৩০টি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ২২টি এবং পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ খাতে রয়েছে ২১টি প্রকল্প। আরও আছে কৃষি খাতে ১৯টি, স্বাস্থ্যে ১৯টি, প্রতিরক্ষায় ১৭টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১১টি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১০টি, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে ১০টি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে সাতটি, সামাজিক সুরক্ষায় সাতটি এবং সাধারণ সরকারি সেবা খাতে আছে পাঁচটি প্রকল্প।
জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ সোমবার বলেন, ওয়ার্ক প্ল্যান অনুযায়ী কাজ না করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কোনো প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই সংশোধনের প্রস্তাব করার নিয়ম। এ ক্ষেত্রে আইএমইডি ও পরিকল্পনা কমিশন দুই জায়গায়ই প্রস্তাব দিতে হয়। কিন্তু এই নিয়ম মানা হয়নি। ফলে এসব প্রকল্প স্টার চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়েই এ কাজটা করতে হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রকল্প পরিচালকদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় ১৩ বছর ধরে চলছে জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমি প্রতিষ্ঠা প্রকল্পটি। ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এরই মধ্যে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু এখনো কাজ শেষ হয়নি। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সময় বৃদ্ধি বা ফের সংশোধনীর কোনো উদ্যোগ নেই। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ২৫৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১১৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এটির অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এই বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ২৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রায় ১২ বছর ধরে চলছে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এটির। কিন্তু এখনো সংশোধন করা হয়নি। আবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকেও বাদ যায়নি প্রকল্পটি। গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে ৭৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল এক কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত এডিপিতে এক লাখ টাকার নামমাত্র বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড (পতেঙ্গা হতে সাগরিকা পর্যন্ত) প্রকল্প। এটি শুরু হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে। তিনবার সংশোধন করার পর শেষ হয় সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদও। কিন্তু সমাপ্ত বা সংশোধন করা হয়নি। ফলে স্টার চিহ্নিত তালিকায় রয়েছে। আরও আছে উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প এবং পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রকল্প, এস্টাবলিশমেন্ট অব শেখ লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজ, গোপালগঞ্জ এবং সাসেক রোড কানেকটিভিটি : ইমপ্রুভমেন্ট অব জয়দেবপুর-চান্দুরা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা রোড চার লেন হাইওয়ে নির্মাণ প্রকল্প। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ। খুলনা হতে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্প এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন-নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত সমবায়ভিত্তিক বহুতল ভবনবিশিষ্ট পল্লি জনপদ নির্মাণ প্রকল্প।