নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চাইলে ইউএস-বাংলার দুর্ঘটনা এড়ানো যেত: বেবিচক

CCTV-footage-US-Bangla

কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলা দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত নেপালের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত না থাকলেও ত্রিভুবন বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ‘চেষ্টার ঘাটতির’ বিষয়টি সেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

সংস্থার চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান বলছেন, “পাইলটের ভুল কিছু থাকলেও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল চাইলে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।”

গতবছর ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরের ওই দুর্ঘটনায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিএস-২১১ এর ৭১ আরোহীর মধ্যে ৫১ জনের মৃত্যু হয়, যাদের ২৭ জন ছিলেন বাংলাদেশি।

ওই দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখার পর নেপালের তদন্ত কমিশন রোববার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিএস-২১১ এর পাইলট আবিদ সুলতান ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ অবস্থায় ছিলেন। ফলে পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সতর্ক ‘ছিলেন না’। মরিয়া হয়ে অবতরণের চেষ্টা না করে তিনি আবার আকাশে ফিরে যেতে পারতেন।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবিদ সুলতানের ফ্লাইট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল সাড়ে ৫ হাজার ঘণ্টার বেশি। ত্রিভুবনে দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজটি ছিল কানাডার বমবার্ডিয়ারের তৈরি একটি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০। ওই ধরনের উড়োজাহাজ আবিদ সুলতান চালিয়েছেন ১৭০০ ঘণ্টার বেশি।

বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বলে আসছিল, শতাধিকবার ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের অভিজ্ঞতা থাকা আবিদের ভুলে ওই দুর্ঘটনা ঘটেনি।

 কিন্তু ৪৩ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কমিশন বলেছে, ইউএস-বাংলার এক নারী সহকর্মী ইনসট্রাক্টর হিসেবে আবিদের সুনাম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ওই যাত্রায় মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন বিএস-২১১ এর পাইলট। তাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল, সেই আলোচনা ছিল ফ্লাইটের সময়ের একটি বড় অংশ জুড়ে।

ওই আলোচনার এক পর্যায়ে আবিদ অনেকটাই ভেঙে পড়েন। ককপিটে বসে নিয়ম ভেঙে তিনি ধূমপানও করেন। অবতরণের আগের ওই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উড়োজাহাজ চালনার বিধিবদ্ধ নিয়মগুলো অনুসরণ করতে ব্যর্থ হন তিনি। আবিদ ও পৃথুলার অসতর্কতার কারণে উড়োজাহাজটি নির্ধারিত পথ থেকে সরে যায়।

তদন্ত কমিশনের সদস্য বুদ্ধিসাগর লামিচানে রয়টার্সকে বলেছেন, “পাইলট ভেবেছিলেন, তিনি উড়োজাহাজটি নির্ধারিত পথে ফিরিয়ে এনে ঠিকমতই অবতরণ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি তা পারেননি।”

ভূমি স্পর্শ করার পর উড়োজাহাজটি রানওয়ের বাইরের চলে যায় এবং অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। ৪৭ আরোহীর সঙ্গে দুই ককপিট ক্রু ও দুই কেবিন ক্রুরও মৃত্যু ঘটে।

ওই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর সোমবার সাংবাদিকদের সামনে আসেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান। নেপালের তদন্ত দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা বেবিচকের ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ এবং ইউএস বাংলার মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের জিএম মো. কামরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, নেপালের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ‘মিথ্যাচার’ নেই। তবে সেখানে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভূমিকা নিয়ে ‘কিছু তথ্য’ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

“নেপাল কমিশন একচেটিয়াভাবে বলেছে পাইলটের দোষ ছিল, সে মানসিকভাবে আপসেট ছিল। সে কারণে সে ভুলভ্রান্তি করে, ফাইনালি ল্যান্ড করতে গিয়ে বাঁকাভাবে ল্যান্ড করেছে।

“কিন্তু আমি বা আমরা আরও ভেতরে গিয়ে তদন্ত করে দেখেছি, সেখানে এটিসি কন্ট্রোলের যথেষ্ট সুযোগ ছিল এটা বলার যে- ‘না… তুমি উড়ে চলে যাও। জাস্ট গো অ্যারাউন্ড… ক্লাইম্ব আপ অ্যান্ড উই উইল লেট ইউ নো.. ‘।”

বেবিচকের এই ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট বলেন, ত্রিভুবনের আকাশ তখন ফাঁকা ছিল, আবহাওয়াও ছিল ভালো। ইউএস বাংলার উড়োজাহাজে কোনো সমস্যা ছিল না, পাইলটদের অভিজ্ঞতারও কোনো ঘাটতি ছিল না।

“এটিসি যদি শুধু বলত- ‘ইউ ক্লাইম্ব আপ অ্যান্ড উই উইল গাইড ইউ’,… তাহলে এই অ্যাক্সিডেন্টটা মোটেও হতো না।”

ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

( ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান -ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান বলেন, “একজন পাইলট প্লেনে ভুল করতেই পারেন। এটা আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে একজন কন্ট্রোলারের এমন ভুল কখনোই করা উচিত না। পাইলট হলো ক্যাপ্টেন অব দ্যা এয়ারক্রাফট। সে যত দক্ষই হোক, তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এটিসি। এটিসির কথা যে কেউ শুনতে বাধ্য।”

ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে দক্ষিণ অংশের নাম দেওয়া হয়েছে রানওয়ে ০২; আর উত্তর অংশকে বলা হয় রানওয়ে ২০। পাইলটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের শেষ চার মিনিটের কথোপকথনের ভিত্তিতে সে সময় বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছিলেন, কোন দিক দিয়ে রানওয়েতে নামতে হবে তা নিয়ে পাইলটের মধ্যে হয়ত বিভ্রান্তি কাজ করছিল।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটসি থেকে জানতে চাওয়া হলে রানওয়ে ২০ তে নামার আগ্রহ প্রকাশ করেন পাইলট আবিদ। তাতে সম্মতি দিয়ে এটিসি জানতে চায়, পাইলট রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন কি না। উত্তরে পাইলট বলেন, ‘অ্যাফারমেটিভ’, অর্থাৎ তিনি দেখতে পাচ্ছেন।

পাইলট তখন রানওয়ের ওই প্রান্তে নামার অনুমতি চান এবং এটিসি থেকে তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর উড়োজাহাজটি হঠাৎ বাঁক নিয়ে খুব নিচু দিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ারের দিকে উড়ে এলে কন্ট্রোলার আতঙ্কে কনসোল ছেড়ে মাথা নিচু করে ফেলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে তদন্ত কমিশন বলছে, ফ্লাইট বিএস-২১১ নামার সময় রানওয়ের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল। ফলে উড়োজাহাজটি  রানওয়ের একপাশে গিয়ে ভূমি স্পর্শ করে। এরপর সীমানা বেড়া ভেঙে ঢালু জমি পেরিয়ে অবতরণের স্থান থেকে ৪৪২ মিটার দূরে গিয়ে থামে। সেখানে বিমানটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়।

 নাঈম হাসান বলেন, “যখন দেখা গেল ক্যাপ্টেন রানওয়ে মিস করেছে, তখন এটিসির কাজ হল তাকে দেখা। তার চাকাগুলো নামানো আছে কিনা দেখা। তখন এটিসির বলা উচিত ছিল মিসড অ্যাপ্রোচ। এটা বলতে পারত। যখন পাইলট ঘোরাফেরা করছিল তখন এটিসি রাডার দিয়ে গাইড করেও তাকে অ্যাপ্রোচে আনতে পারত। এটা কন্ট্রোলারের ফেইলিওর।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কেন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেজন্য কাউকে এককভাবে দায়ী করব না। কোনো দুর্ঘটনা এককভাবে কারো জন্য ঘটে না। সেখানে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। কিছু কিছু ভুল মিলিয়ে একটি সম্পূর্ণ ভুল তৈরি হয়। এটিসি চাইলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।”

সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, “এটিসি একটি কাচের ঘরের মত। সেখান থেকে জাহাজ কীভাবে নামছে সেটাও খেয়াল রাখার কথা। ইউএস বাংলার পাইলট এখানে ল্যান্ডিংয়ের চাকা নামাননি, সেটাও এটিসির নজরে রাখার কথা। কিন্তু তারা করেননি। গ্রাউন্ড থেকে সেখানকার দুইজন পাইলট এটিসিকে বলেছেন, ‘ওদের র‌্যাডার ভেক্টর দাও, মনে হচ্ছে ও হারিয়ে গেছে’। তারপর এটিসির একজন ছোট করে বলেছে এটা নিয়ে। কিন্তু পরে এ নিয়ে কোনো কথা শোনা যায়নি।”

ককপিটে বসে পাইলটের ধূমপান করার যে তথ্য প্রতিবেদনে এসেছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সালাউদ্দিন বলেন, “এয়ারক্রাফটে ধূমপানে নিষেধ করা হয় অনেকাংশে স্বাস্থ্যগত কারণে। এখানে সিকিউরিটির বিষয়ও রয়েছে। তবে ইউএস বাংলা দুর্ঘটনায় ধূমপান কোনো কারণ নয়। কন্ট্রোলার আরেকটু অ্যাগ্রেসিভ হলে হয়ত এই দুর্ঘটনা ঘটত না।”

তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো বিমান দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি করে এক মাসের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন এবং এক বছরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়। সে অনুযায়ী আগামী ১২ মার্চ পর্যন্ত সময় থাকলেও তার আগেই নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন।

“তদন্ত কমিটি দুই মাস আগে তাদের খসড়া প্রতিবেদন আমাদের পাঠিয়েছিল। আমাদের কিছু মন্তব্য তাদের দেয়াও হয়েছিল। তারা কিছু ক্ষেত্রে এক মত ছিল না। তাই ডিসেম্বরে আমরা দুইজন সদস্য সেখানে গিয়েছিলাম। … আমাদের দেওয়া তথ্যের ৮০ ভাগ তারা প্রতিবেদনে যুক্ত করেছে।

“আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি, পাইলট সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক কিছুই, অনেক কথাই উঠে এসেছে, কিন্তু এটিসি সংক্রান্ত বিষয়গুলো তারা পরিপূর্ণভাবে এভয়েড করে চলে গিয়েছে।”

সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, তাদের যে পর্যবেক্ষণগুলো প্রতিবেদনে আসেনি, সেগুলো যুক্ত করে নিতে আবেদন করা হবে। তাতে সাড়া না পেলে তারা আইকাওয়ের কাছে অভিযোগও করবেন।

Pin It