সাড়ে চার বছর পর নিজের লেখা বইয়ে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে এ কে খন্দকার বলেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেননি।
২০১৪ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেও নীরব ছিলেন তিনি।
সেই নীরবতা ভেঙে শনিবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এসে এ কে খন্দকার অসত্য তথ্য দেওয়ার দায় নিয়ে ক্ষমা চান।
তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, “যেভাবেই আমার বইতে আসুক না কেন, এই অসত্য তথ্যের দায়ভার আমার এবং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে কখনই ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বলেননি।
“আমি তাই আমার বইয়ের ৩২ নম্বর পৃষ্ঠার উল্লিখিত বিশেষ অংশ সম্বলিত পুরো অনুচ্ছেদটুকু প্রত্যাহার করে নিচ্ছি এবং একই সাথে আমি জাতির কাছে ও বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা চাইছি।”
প্রথমা প্রকাশন বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠার বিতর্কিত অংশটুকু বাদ দিয়ে পুনঃমুদ্রণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন বইয়ের লেখক একে খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধের উপ সেনাপতি বইটিতে আরও লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা তিনি মনে করেন না।
“আমি এর কোনোটিতেই বিশ্বাসী নই। তাই কখনও কখনও রূঢ় সত্য প্রকাশে ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার বাইরে আমি কিছু মন্তব্য করেছি বা প্রমাণ তুলে ধরেছি। আমি মনে করি, সত্যের স্বার্থে এটির প্রয়োজন ছিল।”
ওই বই প্রকাশের পর শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। বইটি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে সংসদে, আদালতে হয় অভিযোগ।
কোনো মহলের প্ররোচনায় এ কে খন্দকার এই বই লিখেছেন বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বিএনপি নেতারা বলেন, এই বইয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন বক্তব্যের অসাড়তা প্রমাণিত হয়েছে।
এই ঝড়ের মধ্যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছাড়েন এ কে খন্দকার। ফোরামও তার বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছিল।
সাড়ে চার বছরের নীরবতা ভেঙে এ কে খন্দকার বলেন, “আমার বয়স ৯০ বছর। আমার সমগ্র জীবনে করা কোনো ভুলের মধ্যে এটিকেই আমি একটি বড় ভুল বলে মনে করি। গোধূলী বেলায় দাঁড়িয়ে পড়া সূর্যের মতো আমি আজ বিবেকের তাড়নায় দহন হয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মার কাছে ও জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।”
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে ‘স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান’ উল্লেখ করে তার বর্ণাঢ্য জীবনের কথা তুলে ধরেন এ কে খন্দকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে বিশ্বে খ্যাতির শীর্ষে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত। তারই বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে দেশ আজ যুদ্ধাপরাধী মুক্ত।
“জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে পরা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার প্রতি কৃতজ্ঞ।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনামলে পরিকল্পনামন্ত্রীও হন তিনি।
এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে পাবনা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পাঁচ বছর শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এ কে খন্দকার। পরের সরকারে আর ঠাঁই পাননি।
‘প্রথমা সংশোধন করতে দেয়নি’
বইটি প্রকাশের পর তথ্য সংশোধন করতে চাইলেও প্রথমা প্রকাশনের কারণে তা করতে পারেননি বলে দাবি করেছেন এ কে খন্দকারের স্ত্রী ফরিদা খন্দকার।
লিখিত বক্তব্য পড়া শেষ হতেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে এ কে খন্দকার জানান, তিনি শুনতে পাচ্ছেন না।
তখন তার হয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন স্ত্রী ফরিদা।
এত দিন পর এই উদ্যোগের কারণ জানতে চাইলে ফরিদা বলেন, “আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু সাংবাদিকদের সঙ্গে সখ্য না থাকায় চেষ্টা করেও তা করতে পারিনি।”
স্বামী এ কে খন্দকারের অসুস্থতার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “বইটা সংশোধন না করাতে উনি কিন্তু মানসিক রোগী হয়ে গেছেন। সিএমএইচে চিকিৎসা নিয়েছেন একেবারে উন্মাদ পাগল হিসেবে। এখনও তার চিকিৎসা চলছে।”
ফরিদা বলেন, “বইটি প্রকাশের পরের দিনই ও (এ কে খন্দকার) এবং আমি সংশোধন করার কথা ভাবি। কিন্তু উনারাই আমাদের তা করতে দেয়নি। বরং তারা বলেছেন, বন্দুকের গুলি একবার ছুড়লে আর তার পিছনে ছুটে লাভ কী!
“এরপর প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশক মতিউর রহমানকেও আমি ফোনে চেষ্টা করি, কিন্তু পাইনি। একবার পেয়ে বলি যে, এত বড় ভুল কীভাবে হল? তখন তিনি বললেন, ‘এটা তো আমি দেখি না। এর বানান, ব্যাকরণগত ভুল এগুলো দেখার জন্য আলাদা লোক আছে’। এরপর আর তাকে পাইনি, আর সংশোধনও করতে পারিনি।”
ফরিদার অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাফর আহমেদ রাশেদ বলেন, “এ কে খন্দকার সাহেবের সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যের বাইরে সেখানে যা বলেছে সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সুতরাং ওই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।”
তথ্য সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, “বইটি প্রথম প্রকাশের পরপরই আবার দ্বিতীয় সংস্করণ বের করা হয়। সেখানে তিনি সংশোধন করেছিলেন। সেভাবেই বইটি আছে।”
এতদিন কেন বিষয়টি স্পষ্ট করেননি- জানতে চাইলে ফরিদা খন্দকার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বইটি প্রকাশের পর কী যে যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তা বলার মতো নয়। এজন্য আমরা চাইনি, তাদের নাম বলে তাদেরকে এই যন্ত্রণায় ফেলি।”
সাংবাদিকরা নাম জানতে চাইলে তিনি স্বামীর সায় নিয়ে মঈদুল হাসান ও জাফরুল্লাহ চৌধরীর নাম বলেন।
এরা দুজনসহ আরও কয়েকজনের নাম ‘মনে পড়ছে না’ উল্লেখ করে ফরিদা বলেন, “তারা কয়েকদিন ধরে পাহারা দিয়ে রেখেছিল যেন এটা সংশোধন না করা হয়।”
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য সন্ধ্যা থেকে কয়েক দফায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মোবাইলে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
পরে তার একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার নম্বরে ফোন করলে তিনি বলেন, “স্যার, একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে আছেন। পরে উনাকে পাওয়া যেতে পারে।” তবে পরে ওই নম্বরে ফোন করলে আর সাড়া দেননি তিনি।