তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জোরালো প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
তবে চামড়া ও পাট পণ্যের রপ্তানি কিছুটা কমায় রপ্তানির সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে।
রোববার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি থেকে প্রকাশিত চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকের (জুলাই থেকে মার্চ) রপ্তানি তথ্যে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রাকে ছাপিয়ে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের (৩০৯০৩ দশমিক শূন্য দুই মিলিয়ন ডলার) পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা প্রাক্কলনের চেয়ে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২৮ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। রপ্তানির এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবারও বাংলাদেশের রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।
এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মনে করেন, বর্তমানে বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা অবশ্যই সন্তোষজনক। এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর পেছনেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
ব্যাংক ঋণের অধিক সুদ হার এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য কমে যাওয়ার বিপরীতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী ‘অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ছেন’ দাবি করে তিনি বলেন, এজন্য সরকারকে ব্যবসা ও বিভিন্ন খাতের প্রতি আরও যত্নবান হতে হবে। কেবল দুয়েকটি পণ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নতুন নতুন রপ্তানি পণ্য সৃষ্টি করতে হবে।
পোশাক খাত
রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ২২ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় এই খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
ফলে চলতি অর্থবছরে পোশাক থেকে ৩২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক।
তবে পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি থাকলেও চলতি অর্থবছরের শেষ তিন মাস নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ফারুক হাসান। এই সময়ের মধ্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা তার।
“এখন এই প্রবৃদ্ধি দেখছেন তা তো তিন মাস আগের অর্ডার। গত তিন মাসে পোশাক পণ্যের মূল্য কমে গেছে। অনেক কারখানায় অর্ডারও কমে গেছে। ফলে বছরের শেষ তিন মাস চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করি,” বলেন তিনি।
পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধির পেছনে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাইরে যেসব নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করেন এই পোশাক ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, “সদ্য বিজিএমইএতে নেতৃত্ব নির্বাচন হয়ে গেল। নতুন বোর্ড দায়িত্ব নিয়ে নতুন বাজার ও পণ্যের প্রাইস নিয়ে জোর ভূমিকা রেখে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে বলে আমি আশা করছি।”
চামড়াজাত পণ্য
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের উৎস চামড়া শিল্পের খরা আরও প্রকট হয়েছে। অর্থবছরের নয় মাস পার হলেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে বের হতে পারেনি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের এই খাত।
চলতি অর্থবছরে ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি রয়েছে চামড়া শিল্পে। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল এক হাজার ৮৫ মিলিয়ন ডলারের চামড়া পণ্য। চলতি অর্থবছরে ১১শ ২৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য থাকলেও নয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ৭৭১ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলারের চামড়া, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৮৪৮ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গোটা বিশ্বব্যাপীই এখন চামড়া শিল্পের খারাপ সময় যাচ্ছে। তারই প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে সেটাই চামড়াজাত পণ্যের বাজারকে খারাপ করে দিয়েছে।
“চীন বাংলাদেশে থেকে ফিনিস লেদার আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি করত। বর্তমানে এই প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ট্রেড ওয়্যারের কারণে।”
এছাড়া হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তর এই পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন তিনি।
“সাভারে যাওয়ার পর অবকাঠামোগত নানা জটিলতায় পড়েছে এই শিল্প। তবে সরকারকে বর্তমানে সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তাই অচিরেই দেশীয় সমস্যা কেটে যাবে বলে আমরা আশা করি,” বলেন তিনি।
পাট পণ্য
চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাসে ৬২৮ মিলিয়ন ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮১৮ মিলিয়ন ডলার। ফলে এই খাতেও দেখা দিয়েছে ২৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি।
মৎস্য ও হিমায়িত খাদ্য
গত অর্থবছরে ৫০৮ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছিল। এ বছর তিন প্রান্তিকের লক্ষ্য ছিল ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার। তবে এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪১৯ মিলিয়ন ডলার। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৪০৭ মিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
কৃষিপণ্য
গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৬৭৩ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে ৭১১ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্য পূরণ করতে প্রথম তিন প্রান্তিকে ৫২৫ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য ছিল। এই সময়ের মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ৭২২ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার। ৫৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে দেশীয় এই খাত।
কৃষিপণ্যের মধ্যে চা রপ্তানিতে ৭ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি থাকলেও সবজি, তামাক ও শুকনো খাবারে অধিক প্রবৃদ্ধি থাকায় এই খাতের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে গেছে। এই নয় মাসে ৮১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের শাক-সবজি, ৫৫ মিলিয়ন ডলারের তামাকপণ্য এবং ১৬৬ মিলিয়ন ডলারের শুকনো খাবার রপ্তানি করা হয়েছে।
পেট্রোলিয়াম পণ্য
গত অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলারের পেট্রোলিয়াম বাই-প্রডাক্ট রপ্তানি করতে পেরে এবার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩৪ মিলিয়ন ডলার। তবে চমকে যাওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, এ বছরের প্রথম নয় মাসেই ১৮৩ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ৫৯১ শতাংশ।
ওষুধ
গত অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছিল ১০৩ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে ১১২ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য। বছরের আরও তিন মাস বাকি থাকতেই রপ্তানি হয়েছে ৯৯ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৭৬ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার। ফলে দেশের উদীয়মান এই খাত বর্তমানে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এগিয়ে চলছে।
প্লাস্টিক
প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতেও রয়েছে ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। গত অর্থবছরে ৯৮ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের নয় মাসেই রপ্তানি হয়েছে ৮৭ দশমিক শূন্য ৯ মিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিকজাত পণ্য। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
সিমেন্ট রপ্তানিতে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৯ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলারের সিমেন্ট রপ্তানি হলেও এবার হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার।