স্মার্ট হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা। এজন্য স্মার্ট গ্রিড তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শকদের পেছনে ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকার বেশি। এতে তিন ধরনের পরামর্শক থাকবে। এর মধ্যে শুধু পরামর্শকদের জন্য যাবে ৭৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়া ভ্যাট, কাস্টমস ডিউটি ও আইটি খাতে যাবে আরও ২৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ‘মডার্নাইজেশন অব পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন স্মার্ট গ্রিডস ফেজ-১’ শীর্ষক প্রকল্পে এ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভায় পরামর্শক খাতের ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমাতে বলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। সে অনুযায়ী কমানোর পরও এই ব্যয় দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেএফডব্লিউ (জার্মানভিত্তিক উন্নয়ন ব্যাংক) ঋণ দেবে ৬৯৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সরকারি তহবিল থেকে ২৭৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে ৯৪ কোটি টাকা
ব্যয় হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এ ব্যয় প্রসঙ্গে বলেন, যে কোনো প্রকল্পে ঢালাওভাবে পরামর্শক নেওয়াটা বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে আমরা অনেক সতর্ক। পর্যায়ক্রমে এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে কাজ চলছে। তিনি বলেন, এক সময় আমরা দুর্বল ছিলাম। তখন বিদেশিরা আমাদের বলত, তোমাদের দক্ষতার অভাব আছে, আমরা লোক দিচ্ছি। অথবা তোমরা লোক দাও আমরা দেখে নিয়োগ দিচ্ছি। কিন্তু এখন আমরা অনেক দক্ষ। কিন্তু ওই পুরোনো অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সুপারভিশন খাতে পরামর্শকের জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। এছাড়া একম্পানিং মেজার কন্সালটেন্ট ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের জন্য পরমার্শক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। যেটি মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। জিআইএস ম্যাপিং এবং বাস্তবায়নে পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। পরামর্শক সেবা সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদির কাস্টমস, শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এছাড়া পরামর্শক সেবা আইটি ভ্যাট বাবদ ২০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় পরামর্শক খাতে ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমাতে বলা হয়। সেই সঙ্গে পরামর্শক সেবার বিস্তারিত টিওআর প্রকল্প প্রস্তাবে সংযুক্ত করতেও বলা হয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পরামর্শক খাতের ব্যয় প্রসঙ্গে ব্যাখা দিয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)। সেখানে বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যান্ড সুপারভিশন কন্সালটেন্ট (পিআইএসসি) নিয়োগ করা হবে। এরা প্রকল্পের টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত, টেন্ডার ও ইপিসি ঠিকাদারের কার্যক্রম দেখবে। সেই সঙ্গে টেন্ডার মূল্যায়নে সহায়তা এবং সুপারভিশন কাজও করবে। এজন্য ভ্যাট ও আইটি খাত ছাড়া ৩১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আর ভ্যাট ও আইটিসহ ৪১ কোটি ৫২ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যয় ডেসকোর সমজাতীয় প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয়ের চেয়ে বেশি। কারণ প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরামর্শক সাবস্টেশন নবায়ন, ৩৩ কেভি লাইন নির্মাণ, ৩৩ কেভি বে-নির্মাণ, জিআইএস ম্যাপিং এবং স্ক্যাডা বাস্তবায়ন করবে। অপরদিকে ডেসকোর পরামর্শক শুধু স্ক্যাডা বাস্তবায়ন করে থাকে। ‘একম্পানিং মেজার কন্সালটেন্ট ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’ শীর্ষক পরামর্শকরা ওজোপাডিকোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ক্যাডা, বিতরণ সিস্টেম, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও আইটি নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে। এর মধ্যে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার অন্তর্ভুক্ত আছে। এই খাতের পরামর্শক ব্যয় ১৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে ভ্যাট ও আইটিসহ মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই ব্যয় কেএফডব্লিউ অনুদান হিসাবে দেবে। এছাড়া জিআইএস ম্যাপিং পরামর্শক সেবা ও বাস্তবায়নের ফলে ওজোপাডিকোর সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ককে জিআইএস ম্যাপিংয়ের আওতায় চলে আসবে। এর মধ্যে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ খাতের পরামর্শক ব্যয় ২৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে ভ্যাট ও আইটি খরচসহ মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। সমজাতীয় প্রকল্পের তুলনায় এ ব্যয় কম আছে।
কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সাবেক সদস্য (সচিব) এবং বর্তমানে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শরিফা খানের সঙ্গে। শনিবার তিনি বলেন, বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিতে গেলে পরামর্শক নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের শর্ত থাকে। এছাড়া বিদ্যুতের অনেক প্রকল্প। ফলে অভ্যন্তরীণ লোকবল দিয়ে অনেক কাজই করা সম্ভব হয় না। সেই সঙ্গে এখন অনেক বিষয় আপগ্রেডেশন হচ্ছে। এসব নিয়ে জ্ঞানেরও সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোট প্রকল্প ব্যয়ের তুলনায় এই টাকা খুব বেশি নয়। কারণ সরকারি তহবিলের টাকায় প্রকল্প হলে ৫-৭ শতাংশ পরামর্শক ব্যয় সাধারণত অনুমোদন দেওয়া যায়। আর বৈদেশিক অর্থায়ন হলে সেক্ষেত্রে ১০ শতাংশ পর্যন্ত পরামর্শক ব্যয় থাকতে পারে।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে ওজোপাডিকো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার ৪১টি উপজেলায় কাজ করছে। এসব জেলায় বিদ্যমান ৪৮টি বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ১৪ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। বিদ্যমান বিতরণ ব্যবস্থায় সাবস্টেশন ও ফিডারগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং সিস্টেম লস প্রত্যাশিত পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রাহক পর্যায়ে তদারকি এবং স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না থাকায় রাজস্ব আদায়ও দেরি হচ্ছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা অটোমেশন করে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের হার ও সময়কাল কমিয়ে আনা যাবে। এছাড়া প্রকল্পটির মাধ্যমে বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সিস্টেম লস কমিয়ে আনা হবে। পাশাপাশি ওজোপাডিকো এলাকায় মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত এবং প্রকৃত রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, ৯৭টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রকে সেন্ট্রাল স্ক্যাডা সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এছাড়া ২০টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র পুনর্বাসন, ৮টি সাবস্টেশন অটোমেশন সিস্টেম স্থাপন এবং ১২১ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার ৩৩ কেভি নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি ৬১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ৩৩ কেভি বিতরণ লাইন পুনর্বাসন এবং ২০টি ৩৩ কেভি বে-নির্মাণ সম্প্রসারণ করা হবে।