পরিবেশ সুরক্ষার কথা মনে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করুন: প্রধানমন্ত্রী

sheikh-hasina-5c7aad6614e6e

সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রকৌশলীদের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজের মান বজায় রেখে এবং পরিবেশ সুরক্ষার প্রতি যত্নশীল থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ গ্রহণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

শনিবার বিকেলে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে (আইইবি) আইইবি’র ৫৯তম কনভেনশনের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান। খবর বাসসের

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের গুরুভার আপনাদেরই (প্রকৌশলীদের)। কাজেই আমি চাইবো— আপনারা পরিবেশ এবং কাজের গুণগত মান বজায় রাখার বিষয়টি মাথায় রেখেই যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।’

কনভেনশনে দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা বিবেচনা এবং মিতব্যয়ী হয়ে সব সময় উন্নয়ন পরিকল্পনা করার জন্য প্রকৌশলীদের নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের জলবায়ু, ভৌগলিক অবস্থান, আমাদের মাটি-পানি সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে মাটি ও মানুষের কথা ভেবে সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।’

‘যেভাবে খুব মিতব্যয়ী হয়ে, চাষের জমি অপচায় না করে, স্বল্প খরচে সর্বোচ্চ উন্নতি দেশের জন্য যা করতে পারা যায়— সেই কথা সব সময় চিন্তা করতে হবে’, যোগ করেন তিনি।

গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গবেষণার মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আমাদের দেশের মাটি, মানুষ, জলবায়ু, আবহাওয়া সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে কীভাবে আমরা উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে পারি সে বিষয়ে আমাদের নিজেদেরই কাজ করতে হবে।’

তিনি বলেন, গত ৭০ বছর ধরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। স্বাধীনতার পরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন জাতির পিতা গড়ে তুলছিলেন সেই সময় মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে তিনি আমাদেরই প্রকৌশলীবৃন্দের সহায়তায় এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলেন।

যুদ্ধের ভয়াবহতায় সেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা থেকে শুরু করে সমগ্র বাংলাদেশ তখন একটি ধবংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কিন্তু জাতির পিতার নেতৃত্বে অত্যন্ত দ্রুত তখন আমাদের প্রকৌশলীরা দেশের এই অবকাঠামোতে পুনর্গঠন করেন। আর এখনো বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রকৌশলীবৃন্দ সার্বিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।’

প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের অ্যাডহক ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলেন, তার সরকারের ৫ বছর মেয়াদি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণের ফলেই দেশ আজকে এতটা এগিয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন আজকে সমগ্র বিশ্বের কাছে দৃশ্যমান। এখানে অন্য কোনো কিছু নয় একটি রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকতে হয়। বিশেষ করে জনগণের কাছে করা ওয়াদা রক্ষার জন্য।

পূর্বের চেয়ে তার সরকার দেশের বাজেট প্রায় ৭ গুণ বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি দেশের উন্নয়ন বাজেট বাস্তাবায়ন করা প্রকৌশলীদের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার গেলবারে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। আর এই উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা প্রকৌশলীদের।

প্রকৌশলীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই তার সরকারের পক্ষে এই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে উল্লেখ করে দেশের প্রকৌশলীদের এ সময় তিনি ধন্যবাদ জানান।

প্রকৌশলীদের কল্যাণে তার সরকার গৃহীত পদক্ষেপের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের এই ভবন যে জায়গাটায় সেখানকার প্রায় ১০ বিঘা জমি তার সরকার ইনস্টিটিউশনকে প্রতীকী মূল্যে রেজিস্ট্রেশন করে দেয়। শুধু তাই নয়, এই ভবন তৈরির টাকাও সরকার দিয়েছে।

তিনি বলেন, এছাড়া সরকার মেঘনা নদীর তীরে প্রকৌশলীদের স্টাফ কলেজ নির্মাণের জন্যও ৭২ বিঘা জমি প্রতীকী মূল্যে এবং সেই কলেজ নির্মাণেরও জন্যও ৪৬ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করে। এছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্র এবং উপকেন্দ্র নির্মাণেও তার সরকার অর্থ ও জমি বরাদ্দ দিয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্বে নতুন নতুন প্রযুক্তির যে বিকাশ তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে এবং ভবিষ্যতে স্যাটেলাইট সেন্টার করে স্যাটেলাইট নিয়ে দেশেই গবেষণা করা হবে যাতে করে বাংলাদেশ নিজস্ব স্যাটেলাইট নিজেরাই উৎক্ষেপণ করতে পারে সেদিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা কারো কাছ থেকে পিছিয়ে থাকতে চাই না, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’

তার সরকার ধীরে ধীরে ই-টেন্ডারে চলে যাওয়ায় আগের মত এখন আর টেন্ডার বাক্স ছিনতাইয়ের কথা শোনা যায় না উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘কিছু কিছু মন্ত্রণালয়ে এখন বাকি আছে, সেখানেও দ্রুত আমাদের ই-টেন্ডারে যেতে হবে যাতে করে দুর্নীতিমুক্তভাবে আমরা কাজ করতে পারি। উন্নতভাবে কাজ করতে পারি এবং কাজের মান যেন ঠিক থাকে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে শিল্পায়ন যেন দ্রুত হয় সেজন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প গড়ে তোলার সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, কৃষি জমি যাতে নষ্ট না হয়। জলাধারের যেন ক্ষতি না হয়। নদী ও খালবিল বাঁচাতে হবে। এতে পরিবেশ সুন্দর থাকে।’

তিনি এ সময় জলাধার সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমাদের জলাধার রক্ষা করা দরকার। রাস্তা বা কোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় এটি খেয়াল রাখতে হবে। ঢাকা শহরে খাল-পুকুর এখন পাওয়া যায় না। আগুন লাগলে পানি পাওয়া যায় না। চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে জেলখানার পুকুর থেকে পানি সাপ্লাই দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।’

বাংলাদেশের ভূখণ্ড খুব সীমিত এবং লোকসংখ্যা বিশাল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এই জনগণকে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। সাথে সাথে তাদের জীবন-মান যেন উন্নত হয় সে প্রচেষ্টাও সরকারকে অব্যাহত রাখতে হবে।’

এ কারণেই তার সরকার বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কারিগরি বিদ্যালয় গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি এ সময় কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে এ সংক্রান্ত গবেষণার ওপরও জোর দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নতুন নতুন গবেষণার ফলে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন জাতের ধান, শাক-সবজি চাষ হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়েও আমরা বাইরে রফতানি করতে পারছি। এ কারণে ভবিষ্যতে আমরা কৃষিজাত শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ পৃথিবী যতদিন থাকবে খাদ্যেরও ততদিন প্রয়োজন আছে। খাদ্যের চাহিদা কোনো দিন ফুরাবে না।’

তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেনের রাস্তার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে দ্রুতগামী রেল যোগাযোগ (বুলেট ট্রেন) স্থাপন এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি রেল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায়ও তার সরকার উদ্যোগ নেবে বলে জানান।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় আঞ্চলিক যোগযোগ স্থাপনের জন্য বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত নেপাল) এবং বিসিআইএন-ইসি (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর) যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠাতেও আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। আমাদের এ অগ্রযাত্রা কেউ প্রতিহত করতে পারবে না। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। ইনশাল্লাহ আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো।’

আইইবি সভাপতি প্রকৌশলী আব্দুর সবুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী খন্দকার মঞ্জুর মোর্শেদ ও ঢাকা কেন্দ্রের সভাপতি প্রকৌশলী মো. ওয়ালিউল্লাহ সিকদার স্বাগত বক্তব্য দেন। ঢাকা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহাদাৎ হোসেন শিপলু ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী তিনজন প্রকৌশলীকে আইইবি স্বর্ণপদক ২০১৮-তে ভূষিত করেন। স্বর্ণপদক প্রাপ্তরা হলেন— প্রকৌশলী দিপক কান্তি দাস, প্রকৌশলী মো. কবির আহমেদ ভূইয়া ও প্রয়াত প্রকৌশলী মো. খিজির খান।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কৃতিত্বের জন্য শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা কেন্দ্র, শ্রেষ্ঠ উপকেন্দ্র হিসেবে পানা উপকেন্দ্র, আইবি শ্রেষ্ঠ ওভারসিজ চ্যাপ্টার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রেষ্ঠ প্রকৌশল বিভাগ হিসেবে আইইবি’র কম্পিউটার কৌশল বিভাগকে পুরস্কৃত করেন।

Pin It