করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আঁধার নেমেছিল পর্যটন শিল্পেও। পরিস্থিতির উন্নতিতে একে একে সব কিছু খুললেও পর্যটন খাত আংশিক খুলেছে।
কবে নাগাদ পুরোপুরি খুলবে, এখন সেই আশায় আছেন ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান।
আর গভীর সঙ্কটে পড়া পর্যটন খাতকে ‘বাঁচিয়ে’ তুলতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া্র কথা বলছে টুরিজম বোর্ড।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু হলে গত বছরের ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটির সঙ্গে সব পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ, বিনোদন কেন্দ্রও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সংক্রমণের নিম্নগতির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন পন্থায় অফিস-আদালত চালু হলেও কার্যত বন্ধ ছিল পর্যটন খাত। ফলে গত দেড় বছর পর্যটনের খাতের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বেকারই বসে ছিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদে সব কিছু খুলে দেওয়ার পর গত ১৯ অগাস্ট থেকে কয়েকটি শর্তে পর্যটন কেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্রও খোলার অনুমতি মেলে। তবে শর্ত দেওয়া হয়, ধারণক্ষমতার অর্ধেক খালি রেখে চলতে হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে, তার উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ।
মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার নানা শর্তে পর্যটন খাতের বর্তমান চলা যে স্বাভাবিক সময়ের কাছাকাছিও নয়, তা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান কক্সবাজারের চিত্রেই বলে দেয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (পর্যটন সেল) সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, সংক্রমণ কমে গেলেও কক্সবাজারে এখনও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে সেইভাবে মানুষের উপস্থিতি নেই।
তিনি বলেন, “বিদেশিরা সেভাবে নেই। যেসব এনজিও কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় কাজ করে, তাদের কেউ কেউ এখন আসছে। বিদেশি বলতে তারাই। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে একটু চাপ থাকছে।”
বিধি-নিষেধ অনুযায়ী হোটেল-রিসোর্ট, বিনোদন কেন্দ্রগুলো চলছে কি না, তার উপর নিয়মিত নজর রাখছেন বলেও জানান সরকারি এই কর্মকর্তা।
রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও ভিড় হচ্ছে না আগের মতো।
টোয়াব সভাপতি রাফিউজ্জামান বলেন, “ট্যুর অপারেটররা নিজের অবস্থান থেকে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের নিয়ে এখন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতি সরকার আরও পর্যবেক্ষণ রেখেছে। করোনা পরিস্থিতি উন্নত হলে তখন তা দেখে হয়ত একটা ইতিবাচক নির্দেশনা আসবে। তখন আমরাও পুরোপুরি কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পাব।”
বিদেশিরা না এলে এই খাত জমে ওঠার সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি।
“আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো পুরোপুরি চালু হলে হয়ত সেই অবস্থাটা ফিরে আসবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।”
প্রায় দেড় বছর সব বন্ধ থাকার পর এখন প্রায় নতুন করেই শুরু করতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ।
“দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আমাদের রিসোর্টগুলোর চেয়ার-টেবিল, অন্যান্য আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো আমরা ঠিকঠাক করছি। গত এক মাস ধরে গেস্ট আসা শুরু করেছে, তবে অতিরিক্ত গেস্ট নেই।”
এই খাতকে দাঁড় করাতে হলে এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
“এখন আমাদেরকে পর্যটনের অভ্যন্তরীণ দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে বেশি করে এই খাতের সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”
ময়মনসিংহের ভালুকার মেঘমাটি ভিলেজের মতো রিসোর্টগুলো এখন রয়েছে সঙ্কটে।
লম্বা বিরতির কারণে ব্যবসা না থাকায় অনেক উদ্যোক্তার পুঁজি হারানোর কথা বলেন খবির।
তিনি বলেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজে ঋণ তারাই পাচ্ছে, যাদের নিজের জমি আছে। এটা আরেকটু শিথিল করলে অন্যরাও সুবিধা পেত।
পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তিন থেকে পাঁচ তারকা মানের দেশের ৪৫টি হোটেল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহসিন হক হিমেল বলেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বন্ধ থাকায় তারা অতিথি পাচ্ছেন না। ট্যুরিস্ট হোটেলগুলো এখন কিছু ভাড়া দিতে পারছে।
“ট্যুরিস্ট হোটেলগুলো কিছু কিছু দেশীয় গেস্ট পাচ্ছে। তাদের ব্যবসা কিছুটা হচ্ছে। বিজনেস হোটেলগুলো এখন সেভাবে রান করতে পারছে না। বিদেশি ডেলিগেটসরা আসছে না, যে কারণে এখন আমরা দেশীয় ট্যুরিস্টদের বড় ধরনের ডিসকাউন্টে ভাড়া দিয়ে চালাচ্ছি।”
মৌলভীবাজারের গ্র্যান্ড সুলতানের মতে বড় হোটেলগুলো রয়েছে বিদেশি অতিথির অপেক্ষায় ।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার শূন্যে নামলেও চলতি বছরের মধ্যে এই খাতের পরিপূর্ণভাবে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না হিমেল।
“সব ধরনের বিধি-নিষেধ উঠে গেলে আমরা প্রত্যাশা করছি, আগামী বছরের শুরু থেকে এই খাত আবারও পূরিপূর্ণ অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।”
অগাস্টের মাঝামাঝিতে পর্যটন কেন্দ্রগুলো আংশিক চালু করে এই খাতকে এগিয়ে নিতে কিছু পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডে ইতোমধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পর্যটন শিল্পের কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং উত্তরণের কর্মপরিকল্পনায় পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
এই কর্মপরিকল্পনায় স্বল্প মেয়াদি দুই বছর, মধ্য মেয়াদি ২ থেকে ৫ বছর এবং ৫ বছরের পর দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে।
‘গভীর সঙ্কটে নিপতিত’ পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে উল্লেখ করা হয় কর্মপরিকল্পনা প্রতিবেদনে।
বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে এখন নেই পর্যটকের আগের মতো আনাগোনা।
ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “করোনা কারণে প্রায় প্রতিটি সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে পর্যটন সেক্টর।
“গত বছর থেকেই খাত সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করি। এই সেক্টরকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সেইভাবে আমরা কর্মকাণ্ড করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
তবে মহামারীর মধ্যে সব কিছু যে এখনও নিশ্চিত নয়, তা ফুটে ওঠে তার কথায়।
“সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এখনও পর্যবেক্ষণ করছে। ভবিষ্যতে এর গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করছে পর্যটন সেক্টর কোন দিকে যাবে।”