মহামারীকালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফলে পাটচাষিরাও পড়েছেন ক্ষতির মুখে।
“হঠাৎ পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে আমাদের পেটে লাথি মারা কেন?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এই প্রশ্ন করেছেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম।
এবার ৮ বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু ভরা মৌসুমে একসঙ্গে এত পাটকল বন্ধ হওয়ায় ফসলের দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, বর্তমানে দেশে সাইফুলের মতো পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান ০.২৬ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা ১.৪ শতাংশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়, এর থেকে কম বেশি ৮০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি পাটের চাষ হয়। পাবনায় এবার ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে; গতবার হয়েছিল ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে।
সাইফুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতবার ২১০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছিলাম। সে আশায় এবার একটু বেশি জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। এখন শুনছি, এবার পাটের দাম পাওয়া যাবে না। তাহলে আমাদের কী হবে?”
সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে।
পাটনির্ভর এই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে; সবগুলোই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে সচল রয়েছে, ১৩টি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি খাতের জুট মিল করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। পারটেক্স গ্রুপের পারটেক্স জুট মিলও এই জেলাতেই অবস্থিত।
গত মৌসুমে দাম ভালো পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি জমিতে পাটের চাষ করেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি বলেন, এই মৌসুমে এখনও পাট উঠা শুরু হয়নি।
পাশের জেলা রাজবাড়ীতে এবার ৪৭ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোপাল কৃষ্ণ দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এই জেলায় পাট কাটা শুরু হয়েছে। তবে হাট-বাজারে এখনও বিক্রি শুরু হয়নি।
মানিকগঞ্জে এবার ৩৬ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গতবার হয়েছিল ৩৪ হেক্টর জমিতে।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত।
গতবার দাম বেশি পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি জমিতে পাট চাষ করেছেন বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাদের।
এই জেলায় পাট উঠতে শুরু করেছে। বাজারে প্রতি মণ পাট ১৮০০ টাকা থেকে ১৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবার বিক্রি হয়েছিল ২২০০ টাকা পর্যন্ত।
দাম কমায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মানিকগঞ্জের কৃষক শহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার পাটের দাম নাই। সরকার মিল বন্ধ করে দিয়েছে। আরও কমবে নাকি শোনা যাচ্ছে। তাহলে আমাদের কী হবে?
“প্রতি মণ পাট উৎপাদনেই দেড় হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। লাভই যদি না হয় তাহলে মানুষ পাট চাষ করবে কেন?”
কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামানের আশঙ্কা, মৌসুমের ঠিক আগে আকস্মিক পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো কৃষিতে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমন সময়ে সরকার পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল, যখন কয়েক দিন পরেই নতুন পাট বাজারে আসবে। এতে চাষি পাটের উৎপাদন খরচ পাবে না। দেশে এখন বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানার পাটকল আছে। তারা মিলের জন্য পাট খরিদ করবে, কিন্তু দাম দেবে না।
“চাষিরা হাটবাজারে এসে পাটের দাম না পেয়ে আহাজারি করবেন। অনেক চাষি হয়ত রাগে পাটে আগুন লাগিয়ে দেবেন। এই হল আসছে পাট মৌসুমের চিত্র।”
দেশে মোট ৩১৪টি পাটকলের মধ্যে ৬৩টি বন্ধ থাকার কথা গত বছর সংসদে জানিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। এখন একবারেই বন্ধ হল রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি। এর মধ্যেও আরও কয়েকটি বন্ধের খবর পাওয়া যায়।
গত কয়েক বছর ধানের দাম না থাকায় কৃষকেরা ক্রমশ ঝুঁকছিলেন পাটের দিকে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এবার দাম না পেয়ে চাষিরা পাট চাষে আগ্রহ হারালে উৎপাদন কমে যাবে। তাতে সঙ্কটে পড়বে বেসরকারি পাটকলগুলোও।
বাংলাদেশের সূচনা লগ্নে প্রধান রপ্তানি পণ্য পাটকে বলা হত সোনালী আঁশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এই গবেষক বলেন, “কৃষক যদি জানত পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, তাহলে তারা পাটের চাষ না করে শাকসবজি বা অন্য কিছুর চাষ করত।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত পাটের আঁশের প্রায় ৫১ শতাংশ পাটকলগুলোয় ব্যবহৃত হয়, ৪৪ শতাংশের মতো কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় এবং মাত্র ৫ শতাংশের মতো লাগে ঘর-গৃহস্থালি আর কুটিরশিল্পের কাজে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে তা ৪.০-৪.৫ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে ৭ লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। এরপর থেকে তা আরও বাড়ছে।
আগে ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
সরকারি হিসাবে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ হলেও কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন- প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, পরিবহন/স্থানান্তর ও বিপণন ইত্যাদিতে জড়িত।
আঁশ ছাড়ানোর পর পাওয়া পাটকাঠি গ্রামে জ্বালানির প্রধান উৎস; পাটচাষ কমে গেলে পাটকাঠি না পেয়ে বৃক্ষ নিধনের প্রবণতা বাড়তে পারে, যা পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
কৃষিবিদরা বলছেন, পাট চাষ কৃষকদের অন্য পেশায় বা অন্য স্থানে পেশার তাগিদে উপার্জনের জন্য স্থানান্তর কমাতেও ভূমিকা রাখে।
শ্রমিকদের সামনে অনিশ্চয়তা
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ২৫ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ হারালেও তাদের উপর নির্ভরশীল কয়েক লাখ মানুষকে সরকারের সিদ্ধান্তে ভুগতে হবে।
সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরপরই খুলনার পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে, তাদের পরিবারের সদস্যরাও এতে যোগ দেয়।
সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, নতুন ব্যবস্থাপনায় কলগুলো চালু হলে অভিজ্ঞ শ্রমিকরা আবার কাজ পাবেন।
তবে তাতে ভরসা করতে পারছেন না শ্রমিকরা।
শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের কারণে শ্রমিকরা এখন হয়ত কিছু টাকা পাবে। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের কী হবে? তাদের পরিবারের-পরিজনের কী হবে?”
সঙ্কটকালে সরকারের এই সিদ্ধান্তের আরও প্রভাব তুলে ধরে এই কমিউনিস্ট নেতা বলেন, “করোনাভাইরাস দুর্যোগের এই সময়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা বেসরকারি মালিকদের শুধু উৎসাহিত করবে তাই নয়, তাদেরকে বেপরোয়া করে তুলবে।
“বেসরকারি মালিকরা নানা অজুহাতে স্থায়ী শ্রমিকদের ছাঁটাই করে পরবর্তীতে কম মজুরিতে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের কৌশল গ্রহণ করবে, যা সমগ্র শিল্পখাতকে একটি অস্থির অবস্থার দিকে ধাবিত করবে।”
রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন, যাদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আটটি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৯০ সালের পর বিশ্ব ব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় দেশের বৃহত্তম আদমজী জুট মিল।
শেষ পর্যন্ত বিজেএমসির আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট কারখানা। সেগুলোই এখন বন্ধ হয়ে গেল।
স্বপ্নভঙ্গ
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। তা থেকে রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসায় পাটকে বলা হত ‘সোনালী আঁশ’।
তারপর দিন যত গড়িয়েছে, পাটের গৌরব তত ম্লান হয়েছে। কিন্তু প্রায় অর্ধ শতক পর করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে যখন দেশের রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছে, তখন পাটে দেখা যাচ্ছিল আশা, সেই সময়েই পাটকলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত হল।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে। টাকার অঙ্কে তা প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা।
এই অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি হয়েছে ৭ শতাংশ।
গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মধ্যে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ করেছে মোট রপ্তানি ৬৪ শতাংশই এসেছে পাটসুতা রপ্তানি থেকে।
কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৩ কোটি ডলার। এই অংক পাট খাতের মোট রপ্তানির ১৫ শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে কাঁচাপাট রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেশি এসেছে ১৫ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরে পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। লক্ষের চেয়ে আয় বেড়েছে ৮৩ শতাংশ।
এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ডলারের।
আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল পাট।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন পৃথিবীতে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে কিন্তু সুসময় চলছে।
“কোভিড-১৯ মহামারী পরিবেশের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেওয়ায় এ খাতের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে, বিশ্ব বাজারে দামও বাড়ছে। এই সময়ে হঠাৎ করে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে, এটা আমরা চিন্তাই করতে পারিনি।”
বেসরকারি অনেক পাটকল গড়ে উঠলেও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উপর রপ্তানিকারকদের নির্ভরতার কথা জানিয়ে সাজ্জাদ বলেন, “বাংলাদেশের পাট খাত কিন্তু এখনও অনেকটাই বিজিএমসির উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন দেশে যে পাটের বস্তা, থলে ও চট রপ্তানি হয়, তার ৭৫ শতাংশই কিন্তু বিজিএমসির মিলগুলোতে উৎপাদিত। আমরা অনেক রপ্তানিকারকও বিজেএমসি থেকে পণ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকি।”
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল প্যাকেট বা বস্তাবন্দি করতে পাটের থলে লাগবে। অস্ট্রেলিয়া থেকে এরইমধ্যে অর্ডার পেতে শুরু করেছি আমরা।
“আমার বিশ্বাস, পরিবেশের বিষয়টি আরও জোরালোভাবে সামনে আসবে। আর তাতে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে।”
সরকার দেশে পাটের ব্যবহার বাড়াতে ২০১০ সালেই আইন করেছে। সে আইন অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি- এই ছয় পণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়কীকরণে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে সবক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবদুল কাইয়ুম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, শুধু ধান, চাল ও গমে পাটের মোড়ক ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও স্বল্প আকারে; রাজধানী ঢাকায়। জেলা-উপজেলায় কেউ মানছে না এই আইন।”
ছয়টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা গেলে দেশে পাটকলের সংখ্যা আরও বাড়ত এবং কর্মসংস্থানও বাড়ত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে ইউরোপের অনেক বাজারে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সেই বাজার কিন্তু বিশাল; প্লাস্টিকের ব্যাগের বিকল্প হতে পারে পাটের ব্যাগ। ওই বাজার ধরতে আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে।”
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লোকসানে থাকলেও বেসরকারিগুলো এরই মধ্যে লাভ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের আকিজ জুট মিলস পাট সুতা উৎপাদনে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যশোরের নওয়াপাড়ায় মাত্র ৩০০ জন শ্রমিক ও ১০ টন উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে যাত্রা পাটকলটি এখন পাট সুতার বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় ২৫ শতাংশ সরবরাহ করছে। কাজ করছে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক।
বিশ্ববাজারে পাট সুতার বার্ষিক চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। এ চাহিদার এক লাখ টনের বেশি সরবরাহ করছে আকিজ জুট মিলস। বিশ্বের প্রায় ৪০টির মতো দেশে রপ্তানি করছে তারা।
আজিকে কাঁচা পাট সরবরাহ করে দেশের প্রায় আড়াই লাখ কৃষক।
আকিজ জুট মিলসে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ টন সুতা উৎপাদন হচ্ছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জনতা জুট মিলসের উৎপাদন ১০০ টনের কাছাকাছি এবং করিম জুট মিলসের ১০০ টনের নিচে।
এই সাফল্যের কারণ জানতে চাইলে আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও আকিজ জুট মিলসের চেয়ারম্যান সেখ নাসির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাট খাতের হারানো ঐতিহ্য অনেকটাই ফিরিয়ে আনতে পেরেছি আমরা।
লোকসানের কারণে পাটকল বন্ধের কথা জানিয়েছে সরকার; শ্রমিকরা বলছে, কারখানাগুলো আধুনিকায়ন করলে লাভের সুযোগ ছিল।
“পাট খাতের দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী হিসেবে আমার বাবা এ খাতের সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনার পাশাপাশি পাট পণ্যের মানে পরিবর্তন আনি। কয়েক বছরের মধ্যেই সফলতা ধরা দেয়।”
নাসির উদ্দিনও বলেন, “পাট খাতকে আবার উপরে নিয়ে আসা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আমাদের পাট বিশ্বের সবচেয়ে ভালো মানের পাট। পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাপী পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমছে।
“যদি আমরা প্লাস্টিক শপিং ব্যাগের পরিবর্তে জুটের শপিং ব্যাগ উৎপাদন করে সারা বিশ্বে রপ্তানি করতে পারি তাহলে আমরা অন্য বাংলাদেশ দেখতে পাবো।”
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আকিজ জুট মিলস প্রায় ১৫ কোটি ডলারের পাট পণ্য রপ্তানি করেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জনতা সাদাত জুট মিলসের রপ্তানি ছিল সাড়ে তিন কোটি ডলারের কাছাকাছি। অন্যদিকে করিম জুট মিলসের রপ্তানি ছিল ৩ কোটি ডলারের মতো।
বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এবং করিম জুট স্পিনার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্বব্যাপী পাট পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। শুধু এখন বস্তা, চট ও থলে নয়, পাট সুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে।
“আমরা করিম জুট মিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাটের তৈরি একটি পণ্য রপ্তানি করি, যা দিয়ে বিএমডব্লিউ গাড়ির ড্যাশবোর্ড ও সিট তৈরি হয়। এছাড়া এয়ারক্র্যাফটের কার্পেট তৈরিতেও আমাদের এই পাট পণ্যটি ব্যবহার হয়।”
করিম জুট মিল গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৫০ কোটি টাকার পাট পণ্য রপ্তানি করেছে তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি তাহলে আমাদের এ খাতের রপ্তানি অনেক বাড়বে।”
“রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভারতের উপকার করলাম কি না”- সরকারের নীতি-নির্ধারকদের তা ভাবার অনুরোধ জানান মাওনা জুট মিলের কর্ণধার সাজ্জাদ সোহেল।
“এখন কী হবে? আকিজ, জনতা ও করিম জুট মিলের মতো বড় বড় পাটকলগুলো সরাসরি পাট সুতা রপ্তানি করবে। আর আমাদের মতো ছোট ছোট কলগুলোকে ভারতের বড় বড় পাট পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাব-কন্ট্রাকে কাজ করতে হবে।”
‘শ্বেতহস্তী’ বিজেএমসি
পাটকলগুলোতে ক্রমাগত লোকসানের জন্য পাটমন্ত্রী থেকে শুরু করে শ্রমিকরাও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অদক্ষতাকে দায়ী করলেও সেদিকে সরকারের কোনো নজর দেখা যায়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বন্ধ দুই পাটকল চালু এবং বেসরকারি মালিকানায় দেওয়া তিন পাটকল ফিরিয়ে এনে আবার চালু করে। এ জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়।
এর পরের ১০ বছরে সরকারি পাটকল লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। অথচ বেসরকারি পাটকল লাভের মুখ দেখছে।
সব মিলিয়ে সরকারি পাট খাতের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ এখন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসার কোনো রকম অভিজ্ঞতা না থাকা আমলাদের দিয়ে বিজেএমসি পরিচালনা করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন চেয়ারম্যানসহ সাতজন। তাদের প্রত্যেকেই সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মচারী। পাটকলের ব্যবসা পুরোপুরি বোঝার আগেই বদলির ঘটনাও ঘটেছে। গত তিন বছরে দায়িত্বে ছিলেন তিনজন চেয়ারম্যান।
বিজেএমসির উপর পুরো ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। বন্ধ ঘোষণার পরের দিন জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিজেএমসি উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে পাট বিক্রি করায় ভারত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে দেশটিতে বেশি পাট রপ্তানি করা যায়নি। ১০০ টাকা উৎপাদন খরচ হলেও বিজেএমসি তা ৭০ টাকায় বিক্রি করে। ৩০ টাকার জন্য স্থানীয় শিল্পও ক্ষতির শিকার। আবার এই ৩০ টাকা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ব্যয় হয়।
লোকসানের জন্য বরাবরই শ্রমিকের বাড়তি মজুরিকে বড় করে দেখিয়ে আসছেন বিজেএমসির কর্তারা।
পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বলেছে, বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি ২ হাজার ৭০০ টাকা। তবে ২০১৫ সালে সরকারি পাটকলগুলোতে মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে, যা বেসরকারি পাটকলের প্রায় তিন গুণ। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে টিকে থাকতে কম দামে পাটপণ্য বিক্রি করতে হয়। এতে পাট খাতের সার্বিক প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বিনষ্ট হয়।
এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন ডেমরায় রাষ্ট্রায়ত্ত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারি পাটকলের যন্ত্রপাতি ৬০-৭০ বছরের পুরোনো। ফলে পাটকলের উৎপাদনক্ষমতা ৪০-৪৫ শতাংশে নেমে যায়। সে কারণে এক টন পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি মিলে যেখানে ২৫-২৮ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে সরকারি মিলে প্রয়োজন হতো ৬৫-৭০ জন।
তা ছাড়া পাটের মৌসুমে সুলভ মূল্যে কাঁচাপাট না কিনে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনাটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। তাতে ১ হাজার ২০০ টাকা মণের পাট অনেক সময় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনা হত।
এর পেছনেও বিজেএমসির সঙ্গে পাটের দালালদের যোগসাজশ ছিল বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের।
কাদের বলেন, “সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে কোনো কিছু হয় না। শ্রমিকদের বেতন সামান্য বাড়লেই সব দোষ!
“এই বাজারে ৮/১০ হাজার টাকায় একজন শ্রমিকের পরিবার কীভাবে চলে, সেটা কি কোনো সরকারি আমলা ভেবে দেখেছেন কখনও?”
শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) সরকারকে দেওয়া এক সুপারিশে বলেছিল, উন্নত ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির তাঁত, ভিম, ওয়ার্প ওয়েভিং কেনায় মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব ছিলে পাটকলগুলোতে। আর এর মধ্য দিয়ে বিজেএমসিকে লাভজনক করা সম্ভব ছিল।
পাট শিল্প বিকাশে করণীয় নির্ধারণে ২০০৯ সালের ২৪ মে সরকার জাতীয় পাট কমিশন গঠন করেছিল। ওই কমিশন বিজেএমসিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করাসহ অনেকগুলো সুপারিশ করেছিল।
কমিটির প্রধান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাটখাত পুনর্গঠন করতে আমরা যে সুপারিশ দিয়েছিলাম, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। পাটখাতের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে, দক্ষ লোকবলের কারণে আজকে সরকারি পাটখাতের এই অবস্থা।”
উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অব্যবস্থাপনায় ডুবেছে সরকারি পাটকলগুলো। সরকারের উচিৎ ছিল সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। তাহলে দেশের মানুষ বুঝতে পারত, পাট নিয়ে আসলে কী হয়েছে এতদিন? বেসরকারি পাটকলগুলো ভালো করলে সরকারিগুলো কেন করতে পারেনি?
“তাহলে প্রশ্ন জাগে পাট মন্ত্রণালয়-বিজেএমসি কী করেছে। তাদের ব্যর্থতার দায় কে নেবে? অবশ্যই শ্রমিকরা নয়। সরকারকে নিতে হবে; পাটমন্ত্রণালয় বা বিজিএমসিকে নিতে হবে। যারা দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি করে, লুটপাট করে পাট শিল্পকে ডুবিয়েছে তাদের নিতে হবে।”
আকস্মিক সিদ্ধান্ত
মহামারীকালে যখন রপ্তানিতে আশা দেখাচ্ছে পাট, তখন আকস্মিক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত কেন হল, তার কারণ খুঁজতে হয়রান সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপি আমলে দেশের বৃহত্তম আদমজী পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনামুখর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই পাট শিল্প নিয়ে তার আবেগের কথা বলে আসছেন। লোকসানে থাকা পাটকলগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি নানা পদক্ষেপও নিচ্ছিল সরকার।
তাহলে কেন এই সঙ্কটকালীন সময়ে সরকার হাজার হাজার শ্রমিককে বেকার করার পাশাপাশি কৃষকদের সঙ্কটে ফেলার কঠিন এই সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন; তা বুঝে উঠতে পারছেন না কৃষি অর্থনীতিবিদ, পাট চাষি, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, শ্রমিক কেউই।
তবে সিদ্ধান্তটি যে কঠিন ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের কথায়। গত ৩ জুলাই সিদ্ধান্তটি জানানোর সময় তিনি বলেছিলেন, “আজ যখন প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত দিলেন, তিনি খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।”
বাম দলগুলো বলছে, বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে যেমন আদমজী পাটকল বন্ধ করেছিল বিএনপি-জামায়ত জোট সরকার, তার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল এবার বন্ধ করল আওয়ামী লীগ সরকার।
তবে এবারের সিদ্ধান্ত তেমন নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল।
হঠাৎ পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকে বলছেন, বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কিন্তু তেমনটি মনে হয়নি।
“আগে আদমজী বন্ধ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফ অনেক শর্ত দিতে পারে। আমার মনে হয় না, পাট নিয়ে তারা এখন খুব বেশি বিচলিত।
“আমার মনে হচ্ছে, দেশের ভেতরেরই একটি গোষ্ঠী সরকারকে বিভ্রান্ত করে এই কঠিন সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।”
পাটকল শ্রমিকদের নেতা বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী এর পেছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ দেখার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাট শিল্প নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পিপিপির নাম করে কয়েকজন ব্যক্তির হাতে পানির দরে পাটকলগুলোকে তুলে দিতেই এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
সরকারের পক্ষ থেকে পাটকলগুলোতে ধারাবাহিক লোকসানকে কারণ দেখানো হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অবস্থা তো অনেক দিন ধরেই চলছিল। আর সেজন্য তো দায়ী বিজেএমসি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বুদ্ধি কে বা কারা সরকারকে দিল, বুঝে পাচ্ছি না। তবে অনুমান করা যাচ্ছে, পিপিপির নামে হাতেগোনা কয়েকজন বিত্তবানের হাতে নামমাত্র মূল্যে এসব তুলে দিতে চাইছে।”
“আমি কিছু বলব না, তবে যে কেউ যদি প্রশ্ন করে কম দামে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের কাঁচাপাট পার্শবর্তী দেশ ভারতের হাতে তুলে দিতেই কি এভাবে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো?” বলেন তিনি।
পিপিপির সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এই গবেষক
বলেন, পিপিইর মাধ্যমে সরকারি কল-কারখানা চালানোর অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতেও তা ভালো ‘মডেল’ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
“আমার মনে হয়, বাংলাদেশে কখনও পিপিপি সফল হবে না। কেননা, আমাদের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের চরিত্রটাই কেমন জানি আলাদা। তারা শুধু সরকারের কাছ থেকে আদায় করেই যাবে; নিয়েই যাবে। দেশের জন্য কিছুই করবে না। তার বড় উদাহরণ লাখ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।”
“আমরা কেন জানি মনে হচ্ছে, একটা কথা সরকারের লোকজন মনে হয় ভুলে গেছে, বঙ্গবন্ধু পাট নিয়ে কী বলেছিলেন, আর তার অনুসারীরা কী করছেন,” বলেন আসাদুজ্জামান।