অর্ধযুগ আগে চীন থেকে আসা পদ্মা সেতুর পাথর খালাসের মাধ্যমে কার্যক্রমে আসা পায়রা বন্দর পুরোপুরি সেজে ওঠার কাজের অনেক বাকি; এখন চলছে টার্মিনাল ও আরও জেটি নির্মাণ এবং চ্যানেলের গভীরতা বাড়ানোর কাজ।
বন্দরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এসব অংশের বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ হলে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে বন্দর, যা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে কর্তৃপক্ষ।
নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকলেও দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দরকে আগামী বছর জুনের মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত করে ‘বিশ্বকে’ বার্তা দিতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
একই সঙ্গে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে জেগে উঠতে থাকা দক্ষিণের জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হবে পটুয়াখালীর গলাচিপা নদীর মোহনায় স্থাপিত এ বন্দর বলে আশা ব্যবসায়ীসহ স্থানীয়দের।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিকভাবে এগোলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সব অবকাঠামো নির্মাণ শেষে একটি পূর্ণাঙ্গ সমুদ্রবন্দর হিসেবে যাত্রা শুরুর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।
প্রস্তুত হচ্ছে বন্দর
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯০ মিটার প্রস্থের একটি জেটি নির্মাণের কাজ চলছে। বড় এ জেটির পাশে মাল্টিপারপাস কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে, যা লম্বায় ৬৫০ মিটার ও প্রস্থে ৫০০ মিটার। এর কাজও ৪২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
ইতোমধ্যে বন্দরের প্রশাসনিক ভবনের সঙ্গে যুক্ত ৮০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৪ মিটার প্রস্থের একটি সার্ভিস জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। তিন বছর ধরে এ জেটি চালু রয়েছে।
এছাড়া মূল টার্মিনালের পাশে আরেকটি ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৪ মিটার প্রস্থের সার্ভিস জেটির নির্মাণও শেষ হয়েছে। এসব জেটিতে ছোট জাহাজগুলো আসে। বন্দর নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পাথরসহ অন্যান্য কাঁচামালও এখানে খালাস করা হয় বলে কর্মকর্তারা জানান।
বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণে এগুলোর বাইরে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি মূলত কয়লা খালাসের কাজে ব্যবহৃত হয়।
বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া ১০টি মেগা প্রকল্পের একটি হচ্ছে পটুয়াখালীর গলাচিপা নদীর ধারে অবস্থিত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অপরটি পায়রা সমুদ্রবন্দর। প্রায় একই সময়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ।
সম্প্রতি পায়রা সমুদ্রবন্দরের নির্মাণাধীন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ধানখালী নদীর পশ্চিম পাড়ে বন্দরের প্রশাসনিক অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে একটি স্থায়ী ক্রেন স্থাপন করা হয়েছে। ওই অংশের কাছেই ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো।
তিনটি নদী দ্বারা বেষ্টিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের পূর্বপাশেও রয়েছে বন্দরের একটি অংশ। সেখানে কয়লা ও পাথর খালাসের জন্য জেটি বানিয়ে কয়েকটি ক্রেন স্থাপন করা হয়েছে।
সেখান থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে গলাচিপা নদীর মোহনায় এবং রামনাবাদ চ্যানেলের মুখে বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলছে।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, রামনাবাদ চ্যানেল অংশে ইতোমধ্যে ৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সার্ভিস জেটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। সেই জেটি ব্যবহার করে বন্দরের অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের মালামাল আনলোড করা হচ্ছে।
বন্দর ঘুরে দেখা গেছে, জেটিগুলোর নির্মাণ কাজ চলছে। কয়েকটি জেটির পাইলিং শেষ হয়েছে। জেটি বরাবর মূল ভূখন্ড অন্তত ১০ ফুট উঁচু করে ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে। এভাবেই পুরোপুরি প্রস্তুতির পথে যাচ্ছে বন্দর।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল সোহায়েল বলেন, বন্দরের টার্মিনাল তৈরি করা হচ্ছে, ইয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে। অনেক রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট হচ্ছে। এ বন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক কাজ শুরু হয়েছে। এখানে ইপিজেড হবে নতুন করে। পাশাপাশি ডকইয়ার্ড, শিপইয়ার্ড, শিপবিল্ডিং, জাহাজ মেরামতসহ নানা ধরনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে ধাপে ধাপে।
“আশা করি আগামী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এ বন্দর পুরোদমে কাজ শুরু করবে। প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ শেষ হবে। চ্যানেলের ড্রেজিংয়ের কাজটা শেষ হবে।”
বন্দর সংলগ্ন চ্যানেলের গভীরতা এখন ৬ থেকে ৭ মিটারের মধ্যে। কোথাও কোথাও ১৪ মিটারের গভীরতাও রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ খননের মাধ্যমে গড় গভীরতা অন্তত ৯ বা ১০ মিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, দেশি বিদেশি গবেষক প্রতিষ্ঠান দিয়ে এ বন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এ বন্দরের গভীরতা ভালোই আছে, ৬ থেকে ৭ মিটার। সামান্যতম ড্রেজিংয়ের ফলেই গভীরতা অনেক বেড়ে যাবে।
“এ পায়রা বন্দর, শুধু বাংলাদেশ কিংবা এশিয়াতে নয়; বিশ্বে বড় একটা পরিচিতি পাবে। এ বন্দর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।“
ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখনই বাণিজ্যিক কাজ শুরু হয়েছে, ব্যাপক রেভিনিউ আশা শুরু হয়েছে। প্রাথমিক ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে। বেলজিয়ামের একটি প্রতিষ্ঠান কাজটি করবে।”
২০১৩ সালের নভেম্বরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নে রামনাবাদ চ্যানেলের পশ্চিম তীরে ১৬ একর জমির উপর পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বন্দরের নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৬ সালের ১৩ অগাস্ট পদ্মা সেতুর পাথর নিয়ে আসা এমভি ফরচুন বার্ড থেকে পণ্য খালাসের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু এ বন্দরের। তবে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে সব কাজ শেষের কথা কথা থাকলেও নানা কারণে পিছিয়ে গেছে। তবে জাহাজ ভেড়ার অবকাঠামো নির্মিত হয়ে যাওয়ায় আগেই পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে।
এছাড়া পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন নিয়ে প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও অর্থায়নসহ অন্যান্য জটিলতায় তা থেকে পরে সরে আসে সরকার।
চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রমও
পদ্মা সেতুরে নির্মাণ সামগ্রীর অধিকাংশই পায়রা বন্দর হয়েছে দেশে ঢুকেছে। কাস্টমস, প্রশাসনিক ভবনসহ বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি লোকবলও নিয়োগ করা হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের পর তিন বছরে এ বন্দর দিয়ে পাথর ও অন্যান্য পণ্য এসেছে। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল তিন লাখ ১৫ হাজার ১২১ টন।
২০১৯ সাল থেকে কয়লার চালান খালাস শুরু হওয়ায় পণ্য খালাসের পরিমাণও বাড়ে। ২০১৯ সালে এক লাখ ৪৬ হাজার ৪৭২ টন কয়লাসহ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯২ টন পণ্য খালাস হয়। পরের বছর ১৪ লাখ এবং ২০২১ সালে ১৫ লাখ টন পণ্য খালাস হয়।
বন্দর চেয়ারম্যান সোহায়েল বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিক কাজ শুরু করে দিয়েছি। একদিকে উন্নয়ন হচ্ছে, আরেক দিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম দুটোই পাশাপাশি চলছে। আগামী বছর জুনের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে বেগবান করতে পারব। সারাবিশ্ব জানতে পারবে যে, পায়রা বন্দর পুরোপুরি অপারেশনে আছে।“
ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের আশা, পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠবে বন্দরটি। উপকূলীয় এলাকার হাজারো বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে।
পটুয়াখালী চেম্বারের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমাদের চেম্বারে তারা আবেদন করে রাখছেন। এ বন্দর চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক উন্নয়নের দ্বার খুলে যাবে।
“আমাদের এখানে ইপিজেড হতে যাচ্ছে। সেখানে এলপিজি প্লান্ট, পোশাক কারখানার জন্য ব্যবসায়ীরা জায়গা কেনা শুরু করেছেন।”
পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বন্দরকে কেন্দ্র করে আমদানিকারকদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। দেশের মোট আমদানির অন্তত ৩০ শতাংশ পণ্যও এ বন্দর হয়ে ভেড়ানো যায় কি না সেই পরিকল্পনা আমরা করছি।