নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। দেশের হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটলেও কপাল ফিরছে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই উদ্দেশ্যও ভেস্তে যেতে বসেছে। দিন দিন কমছে ঋণদান। বিপরীতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এ প্রতিষ্ঠানের ২৯ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আর্থিক লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। গত ১৯ জুন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের উপসচিব কাজী মোশতাক জহির এ ব্যাপারে দুদককে চিঠি দিয়েছেন।
মন্ত্রণালয়ের তদন্তে পাওয়া অনিয়মের মধ্যে রয়েছে- প্রতিষ্ঠানের অর্থ সরকারি ব্যাংকের পরিবর্তে বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর করে কমিশন আদায়, শীর্ষ কর্মকর্তার অতিরিক্ত বেতন-ভাতা নেওয়া, টিআর-কাবিটা প্রকল্পের কাজে কমিশন আদায়, ভুয়া কোম্পানিকে কাজ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নামে সদস্যদের অর্থ আত্মসাৎ, কর্মীদের জীবন বীমা করিয়ে দিয়ে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নেওয়া, বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, অবৈধভাবে পদোন্নতি-বদলি বাণিজ্য প্রভৃতি।
এ প্রসঙ্গে পিডিবিএফের কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আফজাল হোসেন বলেন, পিডিবিএফের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রতিষ্ঠানটির বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহা একটি মামলা করে ছয় মাসের জন্য আদালত থেকে বোর্ডের কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রশাসনিক অনিয়মের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।
পিডিবিএফের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও সমবায় বিভাগের সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, বোর্ডের ৭৪তম সভায় অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে ৭৫তম বোর্ডসভা আহ্বানের জন্য তিনি এমডিকে চিঠি দেন। এমডি ওই চিঠির বিরুদ্ধে আদালতে রিট করে বলেন, সচিব এভাবে বোর্ড মিটিং ডাকার কথা বলতে পারেন না। আদালত তখন ছয় মাসের জন্য বোর্ডের কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এর ফলে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আর্থিক অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তদন্ত রিপোর্টও পাঠানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গত ৪ জুলাই পিডিবিএফের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মদন মোহন সাহার কথা বলতে চাইলে তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে কোনো অনিয়ম উঠে আসার বা সে রিপোর্ট দুদকে পাঠানোর ব্যাপারে কিছু জানা নেই তার। তবে যেকোনো বিষয় তিনি আইনগতভাবেই লড়বেন।
দেশের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশ্যে ২০০০ সালে পিডিবিএফ গঠন করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে শুরু করে। গত ৯ ডিসেম্বর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসরিন আক্তার চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দু’জন ছিলেন যুগ্মসচিব খালিদ পারভেজ খান ও উপসচিব মো. আজম-ই সাদাত। গত ৪ এপ্রিল তদন্ত কমিটি ১০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এতে উঠে আসে পিডিবিএফে সংঘটিত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র।
অতিরিক্ত বেতন নেওয়া :জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুসারে কোনো কর্মকর্তার ১৭ বছর চাকরিজীবন পূর্ণ হলে তিনি দ্বিতীয় গ্রেডের বেতন স্কেল পেতে পারেন। কিন্তু পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি মদন মোহন তার চকরিজীবন ১৪ বছর হওয়ার পরই দ্বিতীয় গ্রেডে ৬৬,০০০ টাকা বেতন স্কেলে বেতন নিতে থাকেন। পরে একইভাবে তার বেতন প্রথম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে তিনি ৭৮,০০০ টাকা বেতন স্কেলে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন যা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত।
বেসরকারি ব্যাংকে টাকা বিনিয়োগ করে কমিশন : পিডিবিএফের ৬৩তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ সরকারি ব্যাংকে এফডিআর করা হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানের ১০০ কোটি টাকা চারটি বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- মিডল্যান্ড ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বেসরকারি ব্যাংকে টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে এসব ব্যাংক থেকে কমিশন বাবদ আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
পুরনো মাল দিয়ে নতুনের দাম :সরকারের টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের সৌরশক্তি প্রকল্পের জন্য সাত কোটি ৭৪ লাখ টাকায় বিভিন্ন ধরনের সৌরসামগ্রী কেনা হয়। মিরপুরের ২ নম্বর সেকশনের ৩ নম্বর এভিনিউয়ের ১২ নম্বর প্লটের ‘সলিটন ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী’কে এসব সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি নতুনের পরিবর্তে পুরনো মালপত্র সরবরাহ করে। এ জন্য ভারপ্রাপ্ত এমডি মদন মোহন সাহা ও প্রকল্প পরিচালক সহিদ হোসেন সেলিম প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ২০ লাখ ৪১ হাজার ১৬২ টাকা ঘুষ নেন। মোট ছয়টি চেকের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয়। এসব টাকা বেসিক ব্যাংকের মিরপুর শাখায় পিডিবিএফের হিসাব সহকারী সাইফুল ইসলামের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। সহিদ হোসেন সেলিম ও তার ভাগিনার ইস্টার্ন ব্যাংক মিরপুর শাখার একটি অ্যাকাউন্টেও ক্যাশ হয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সাইফুল ইসলামকে নাটোরে বদলি করা হয় ও সহিদ হোসেন সেলিমকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে সলিটনের ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির কোনো অফিস খুঁজে পায়নি। দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্স হালনাগাদ নেই। টিন সার্টিফিকেটও ভুয়া।
এ প্রসঙ্গে সহিদ হোসেন সেলিম বলেন, এসব কথা ঠিক নয়। তিনি জানান, তার বিষয় তিনি বলতে পারবেন। অন্যদের ব্যাপার কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।
মামলার খরচের নামে আত্মসাৎ :মামলার খরচের নামে পিডিবিএফের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫০ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। ওই টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ পিডিবিএফে পাওয়া যায়নি। নোটশিটেও খরচের বিস্তারিত উল্লেখ নেই। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারপ্রাপ্ত এমডি ওই টাকা নিজে নিয়েছেন।
উৎকোচ নিয়ে চাকরিতে বহাল :পিডিবিএফ কর্মচারী প্রবিধানমালা ২০১১-এর ৬৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে টানা ৩০ দিন অনুপস্থিত থাকলে তার চাকরি বিলোপ হবে। কিন্তু কর্মচারী হাবিবুর রহমান টানা ১০০ দিন অনুপস্থিত থাকার পরও তাকে চাকরিতে বহাল রাখা হয়। তদন্ত কমিটির মতে, এতে চাকরির প্রবিধানমালা অনুসরণ করা হয়নি। যারা তাকে চাকরিতে বহাল রেখেছেন, তারা সুবিধাভোগী হয়েছেন হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে।
বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই জনবল নিয়োগ :পত্রিকা বা অভ্যন্তরীণ কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০১৭ সালে ৯২ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কমিটি দেখেছে, নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যবিবরণী জারির তারিখ উল্লেখ নেই। কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি নিয়োগে ২ থেকে ১০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়েছে।
পরিচালককে অবৈধভাবে পদোন্নতি :২০১৪ সালে সংস্থার অর্থ আত্মসাতের দায়ে পিডিবিএফের পরিচালক সহিদ হোসেন সেলিমের পদোন্নতি আদেশ স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মদন মোহন সাহা বিধিবহির্ভূতভাবে এ আদেশ প্রত্যাহার করে নেন এবং তাকে বকেয়া পদোন্নতি দিয়ে পরিচালক পদে আসীন করা হয়। তদন্ত কমিটির মত, সাজা কমানোর এখতিয়ার পিডিবিএফ কর্তৃপক্ষের নেই। অবশ্য এ বিষয়েও সহিদ হোসেন সেলিম বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক ছিল না।
অর্থ আত্মসাতে পুরস্কার :পিডিবিএফ সিবিএ সভাপতি তাপস চন্দ্র রায়ের স্ত্রী কিশোরগঞ্জের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের সময় গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ করা সংস্থার ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ২১ টাকা আত্মসাৎ করেন। ধরা পড়ার পর তাকে বরখাস্ত করা হয়। পরে ছবি রানী টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু পরে তার কাছ থেকে ওই টাকা ফেরত না নিয়েই তাকে প্রধান কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। বরিশাল অঞ্চলের সহকারী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা ঝর্ণা রাণী মণ্ডল ১৬ লাখ ৪ হাজার ৬৫২ টাকা আত্মসাৎ করায় তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু পরে তার কাছ থেকে টাকা ফেরত না নিয়েই চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। এ ছাড়া খুলনার কালিয়ার মাঠ কর্মকর্তা নিতীশ কুমার সরদার ও জিতেন্দ্র নাথ রায়সহ কয়েকজন অর্থ আত্মাসাৎ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নিয়ম লঙ্ঘন করে পদোন্নতি : ২০১৭ সালে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ছাড়াই ও কমিটির সদস্যদের না জানিয়ে ১২তম গ্রেডের ২০ কর্মীকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সংশ্নিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ২০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
অদক্ষতার কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি : শীর্ষ কর্মকর্তার অদক্ষতার কারণে পিডিবিএলের মাঠ পর্যায়ে ঋণ বিতরণে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে পিডিবিএফ। ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে ঋণ বিতরণ আগের বছরগুলোর তুলনায় কমেছে। ৫২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালনের দুই বছরে মোট ১২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ সময়ে সংস্থার প্রবৃদ্ধির হারও নিম্নমুখী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আনোয়ারুজ্জামানকে দু’বছর বিভাগীয় মামলায় ঝুলিয়ে চাকরিজীবনের শেষ দিনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত, অনৈতিকভাবে সৌরশক্তি প্রকল্পের একশ’ কর্মীকে চুক্তিভিত্তিক ঋণ আদায়কারী ও সহকারী ঋণ আদায়কারী হিসেবে নিয়োগ, উচ্চপদের কর্মকর্তার দুর্নীতির তদন্তে নিম্নপদের কর্মকর্তাকে নিয়োগ, নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে সুমন সরকারকে চালক পদে নিয়োগ, ড্রাইভার কুদ্দুস মোল্লার ভাগিনা মো. আশরাফের কাগুজে কোম্পানি এক্সিলন বাংলাদেশ লিমিটেডকে কাজ ছাড়াই ৪৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪০ টাকা অগ্রিম দেওয়াসহ নানা অনিয়ম উঠে এসেছে।