পুরনোদের কারণে বাসা পাচ্ছেন না নতুন মন্ত্রীরা

Untitled-65-5caa55add58cd-5caa5fe58555e

মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এখন ৪৬ জন। অথচ তাদের বসবাসের জন্য সরকারি বাসা রয়েছে মাত্র ২৩টি। ফলে ৪৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মধ্যে ২৩ জনেরই কোনো আবাসন নেই। বাকি ২৩ জন মন্ত্রী সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু বরাদ্দ করা বাসায় এখনও উঠতে পারেননি ১২ জন। কারণ গত মন্ত্রিপরিষদের মেয়াদ শেষ হলেও সরকারি বাসা ছাড়েননি অনেক সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।

এ ছাড়া ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে একাধিক সচিব মন্ত্রীদের বাসা বরাদ্দ নিয়ে পর্যায়ক্রমে বসবাস করে চলেছেন। মন্ত্রীদের আবাসন সংকট হলেও তাদের বাসা বদল হয়নি। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনী এলাকা থেকেই অফিস করছেন অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী।

সরকারি আবাসন পরিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাসা স্বল্পতার কারণে আবেদন করে বাসা পাননি ছয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। কয়েকজন মন্ত্রী আবাসন সংকটের কথা জানতে পেরে জানিয়েছেন, তাদের আপাতত বাসার প্রয়োজন নেই। কয়েকজন আবেদনই করেননি।

আবেদন করে বাসা না পাওয়া ছয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হলেন- বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল। তাদের দেওয়ার মতো কোনো বাড়ি নেই বলে জানিয়েছে আবাসন পরিদপ্তর। একই কারণে আরও ১৭ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বাসা বরাদ্দ দিতে পারেনি সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সমকালকে বলেন, বাসার জন্য আবেদন করলেও এখনও পাইনি। অফিস করছি প্রতিদিন সাভার থেকে। সকাল ৭টায় রওনা হলে অফিসে ঠিক সময়েই পৌঁছানো যায়। তবে ফিরতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। যেদিন কাজের চাপ বেশি থাকে, সেদিন সন্ধ্য ৭টায় অফিস শেষ করে বাসায় ফিরি। আন্তর্জাতিক বা জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সকালেই বাসা থেকে বের হই। তিনি বলেন, সাভার থেকে যাতায়াতে কিছুটা বেশি সময় লাগলেও এলাকায় থাকায় জনগণকে নিয়মিত সময় দেওয়া যায়। সংসদীয় আসনে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা যায়।

মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বসবাসের জন্য বর্তমানে ১৬টি বাংলো ও ১৭টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এ ছাড়া নতুন ১০টি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে। এতে মন্ত্রীদের বসবাসের জন্য মোট বাসা হবে ৩৩টি। তবে নতুন ১০টি অ্যাপার্টমেন্টের কাজ শেষ হতে আরও কয়েক মাস লাগবে। এর মধ্যে মন্ত্রিসভার পরিধি আরও বাড়তে পারে। কারণ, সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সদস্য ছিলেন ৫২ জন। আর বর্তমান মন্ত্রিসভায় সদস্য রয়েছেন ৪৬ জন। ফলে নতুন ১০টি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হলেও আরও প্রায় ২০টি বাসা সংকট থাকবে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, মন্ত্রীদের আবাসন সংকট নিরসনের জন্য মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। তাই যারা আবেদন করেছেন তাদের সবাইকে সরকারি বাসা বরাদ্দ দেওয়া যাবে। তবে যেসব মন্ত্রীর ঢাকায় নিজস্ব বাসা রয়েছে, তাদের সরকারি বাসা বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। যারা বরাদ্দ পেয়েছেন তারা পর্যায়ক্রমে বরাদ্দকৃত বাসায় উঠবেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রিত্ব শেষ হওয়ার তিন মাস পার হলেও এখনও সরকারি বাসায় বাস করছেন সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান (৫ নং মিন্টো রোড), সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু (ছায়াবীথি-৬, ‘নিলয়’, হেয়ার রোড), সাবেক রেলপথমন্ত্রী মো. মজিবুল হক (২০ পার্ক রোড), সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ (৩৫নং মিন্টো রোড), সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল (৫ নং মিন্টো রোড), সাবেক মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট ১নং ভবনের ২য় তলা পশ্চিমাংশ) এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত (ছায়াবীথি-২ ‘তন্ময়’, হেয়ার রোড)। এ ছাড়া গত ৩ জানুয়ারি সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মারা গেলেও তার পরিবারের সদস্যরা এখনও ২১ বেইলি রোডের বাসায় বসবাস করছেন। মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট ১নং ভবনের ৪র্থ তলায় (পশ্চিমাংশ) বাস করছেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন সিকদার। এ ছাড়া ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান পুনরায় দায়িত্ব নেওয়ার পর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাংলোতে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু বাংলো খালি না হওয়ায় অ্যাপার্টমেন্টগুলোও খালি করেননি তারা।

নতুন মন্ত্রীদের শপথের পরপরই তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ২৩টি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সাবেক মন্ত্রীরা বাসা না ছাড়ায় ১২ জন নতুন মন্ত্রী বরাদ্দকৃত বাসায় উঠতে পারেননি। আবাসন পরিদপ্তর থেকে সাবেক মন্ত্রীদের বাসা ছাড়ার জন্য একাধিকবার তাগাদা দেওয়া হলেও তারা বাসা ছাড়েননি। কয়েকজন নতুন মন্ত্রী বাসা বরাদ্দ পাওয়ার পর নিজেও যোগাযোগ করেছেন। এরপরও তারা বাসা খালি করেননি।

সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা সমকালকে বলেন, আবাসন পরিদপ্তরের পরিদর্শকরা তদন্ত করে খালি হওয়া বা না হওয়া বাংলো শ্রেণির বাড়ি ও মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্টগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছেন। এ তালিকা অনুযায়ী সাবেক মন্ত্রীদের আবারও তাগাদা দেওয়া হবে। তবে সাবেক মন্ত্রীরা সিনিয়র এবং একই দলের হওয়ায় বারবার তাগাদা দিয়ে কাজ হচ্ছে না। এ বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠিও ইস্যু করা যাচ্ছে না। যদিও তাদের মোবাইল ফোনে কয়েকবার বাসা ছাড়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বাসভবন বরাদ্দে কোনো সংকট হয়নি। তবে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে একাধিক সচিব মন্ত্রীদের বাসভবন বরাদ্দ নিয়ে পর্যায়ক্রমে এখনও বসবাস করছেন। সরকার বদল হলেও তাদের বাসা বদল হয়নি। ৯, ১০, ১১ ও ৩৮ মিন্টো রোডসহ আরও কয়েকটি বাসায় ২০০৬ সালের আগে মন্ত্রীরা বসবাস করলেও এখন সচিবরা বসবাস করছেন।

এ প্রসঙ্গে সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক শেখ আতাহার হোসেন সমকালকে বলেন, তাদের কাজ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বাসা বরাদ্দ দেওয়া। কিন্তু এখনও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে সরকারি বাসা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি বাসা আবাসন পরিদপ্তরের নেই। তাই অনেকে আবেদন করলেও বাসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, দীর্ঘসময় হলো মন্ত্রীদের থাকার উপযোগী নতুন কোনো ভবন তৈরি হয়নি। এখন নতুন কিছু বাসা তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অবশ্য কয়েকটি নতুন বাসা তৈরি হচ্ছে। যেগুলোর কাজ শেষ হলে সংকট কিছুটা কাটবে। বর্তমানে তাদের জন্য যে বাসাগুলো রয়েছে, সেগুলোও মানসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেন শেখ আতাহার হোসেন।

আবাসন পরিদপ্তরের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আবাসন সংকটের কারণে বর্তমানে নগরীর কয়েকটি স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছেন মন্ত্রীরা। এতে সরকারের আইন-শৃঙ্খলাসহ নানা খাতে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। মন্ত্রীদের একসঙ্গে বসবাসের ব্যবস্থা করা গেলে সরকারের ব্যয় অনেকাংশে কমে আসবে। সেসঙ্গে প্রয়োজন পড়বে না রাত্রিকালীন পৃথক নিরাপত্তা ব্যবস্থারও।

দ্য মিনিস্টার্স, মিনিস্টার্স অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টার্স (রেমিউনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজ) (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৬ অনুযায়ী, সরকারি বাসায় না থাকলে মন্ত্রীরা বাড়ি ভাড়া বাবদ ৮০ হাজার টাকা এবং প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা ৭০ হাজার টাকা পাবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব (বিধি, সেবা ও আইন) শফিউল আজিম সমকালকে বলেন, সরকারি বাসা না নিলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রতিমাসের বেতন-ভাতার টাকার সঙ্গে বাসা ভাড়াও পান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা।

Pin It