অর্থনীতিকে সচল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বন্দর পুরোদমে চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণে মনিটরিং করতে বলা হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতিশীল এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শনিবার এক বৈঠকে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এসব নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যানকে।
এর আগে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে প্রবেশের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক খাত সংস্কার করা হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হোক, এরপর সংস্কারের প্রসঙ্গ আসবে। এখনই সংস্কার শুরু হলে মূল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা চলে আসেন অফিসে। এ সময় অর্থ সচিব ড. মোহাম্মদ খায়েরুজ্জামান মজুমদার ফুলেল শুভেচ্ছায় তাকে বরণ করেন। এরপর তিনি দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে টানা ৩ ঘণ্টা বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিবদের সঙ্গে। ওই বৈঠকে অর্থ সচিবসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খান, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের খান, এনবিআরের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতি সচল রাখতে স্বল্প মেয়াদের কাজের বিষয়গুলো উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিবরা। বৈঠক শেষে জানতে চাইলে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, অর্থনীতির গতি ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব ব্যাংক ও পুঁজিবাজার সচল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখা হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে কে আছেন বা চলে গেছেন সেটি আমাদের এখন বিবেচ্য বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন ও নিয়মনীতি অনুযায়ী যারা আছেন তারা কাজ করবেন। মানুষের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকের কার্যক্রম চলবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে বন্দর কার্যক্রম চালু থাকবে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থনীতি সচল রাখা হবে।
তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিকভাবে কাজ করলে সমস্যা হবে না। কেউ অতিরিক্ত কিছু বিগত সময় করে থাকলে সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ল’ অ্যান্ড অর্ডারসহ অতিদ্রুত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিছু বিশেষ বিষয় আছে দীর্ঘ মেয়াদে করা হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান পদত্যাগ করবেন এমন শোনা যাচ্ছে- এ প্রসঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, না এমন কিছু নয়।
রাজস্ব আদায়ে এনবিআরকে যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে সেটি আদায়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি তদারকি (চেয়ারম্যান) করবেন।
ব্যাংকপাড়ায় অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে- ব্যাংকের ডিজি ও এমডিদের নিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ হয়তো পদত্যাগ করছে। তবে যারা আছে তারা নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেই অফিসে আসবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিসে আসার জন্য কাউকে বলা হয়নি। তারা জীবনের নিরাপত্তা না পায় সে ঝুঁকি আপনি বা আমি কেউ নিতে পারব না।
পুলিশের অনুপস্থিতিকে অর্থনীতি সচলের বাধা কিনা প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, না, মূলত একটি পরিস্থিতিতে অনেকে চাকরি অব্যাহতি দিয়েছে, অনুপস্থিত আছে। তবে প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
এর আগে নিজ দপ্তরে প্রবেশের সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। এ সময় তিনি বলেন, দেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। এ মুহূর্তে মূল কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা। আইনশৃঙ্খলা মানে শুধু রাস্তাঘাটের আইনশৃঙ্খলা নয়, বরং ব্যাংক পুরোপুরি চালু করা, বন্দরগুলো অনেকাংশে অচল সেগুলো চালু করা। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, যেমন মূল্যস্ফীতি, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করা হবে। অর্থনীতি মন্থর হতে পারে, কিন্তু থমকে গেলে পুনরায় চালু করতে অনেক সময় লেগে যায়। সুবিধা হলো বাংলাদেশের মানুষের অফুরন্ত কর্মস্পৃহা আছে। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই কাজে যোগ দেবেন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই সরকারের খুব বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা নেই। ‘ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য আমরা মসৃণ পথ তৈরি করে যেতে চাই। সেজন্য সাংবাদিকদের সহযোগিতা দরকার। আমাদের কর্মোদ্যোগী মানুষ দরকার। শুধু নির্দেশনা পেলে কাজ হয়ে যাবে, এমন হলে চলবে না।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভুলত্রুটি হলে সমালোচনা করবেন, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা না করার আহ্বান জানান তিনি।
লাইনচ্যুত অর্থনীতিকে লাইনে আনতে কত সময় লাগবে, এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমার মনে হয় না মৌলিক কাজগুলো করতে বেশি সময় লাগবে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছিল, একেবারে লাইনচ্যুত হয়ে যায়নি। বরং গতি হারিয়ে ফেলেছিল। আমরা গতি বৃদ্ধি করব।’
এখন বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি ছাড়াও উন্নয়ন কৌশলে ভুল ছিল। মানুষ সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের সুফল পায়নি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু তার ফল কে পেয়েছে, কাদের কাছে টাকা গেছে, সেটাই মূল বিষয়। সরকার চায়, সমতাভিত্তিক ও ন্যায্য প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। সব মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে। সদ্য পদত্যাগী গভর্নরের আমলে দেশের অনেক ব্যাংকে কেলেঙ্কারি হয়েছে। কিন্তু তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলে কি তিনি জবাবদিহির আওতা থেকে বেরিয়ে যাবেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গভর্নরের পদ সংবেদনশীল। তিনি পদত্যাগপত্র দিয়েছেন, এ বিষয়ে আগামীকালের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন বা দেশের যে কোনো আইন যথেষ্ট আন্তর্জাতিকমানের। কিন্তু তা মানা হয় না। যাদের মানানোর কথা তারা সেটা করেননি। যাদের মানার কথা, তারাও মানেননি। অর্থ পাচার প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা সবাই জানি, এ বিষয়ে তথ্য লাগবে। এর প্রক্রিয়া আছে, তা মেনেই এসব করতে হবে।’