করোনার অভিঘাতে স্থবির অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজের সবার হাতেই টাকার সরবরাহ থাকতে হবে। যেমনটি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও করা হচ্ছে। কারণ শুধু উৎপাদকদের হাতে টাকা গেলে হবে না। উৎপাদিত পণ্য কিনবেন যিনি, তার হাতেও টাকা থাকতে হবে। নইলে পণ্য কিনবেন কীভাবে? উৎপাদক থেকে ভোক্তা—কাউকে এখানে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
একই ভাবে একজন চা-দোকানি থেকে শুরু করে মাঝারি উদ্যোক্তা পর্যন্ত—সবার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সবাইকে প্রণোদনার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-ব্যবসা খাত শ্রমঘন। প্রচুর কর্মিবাহিনী এসব খাতে কাজ করে। তাই শুধু বড় উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দিলেই অর্থনীতি ঠিক থাকবে এমন ধারণা ভুল। সব খাতকেই প্রণোদনার আওতায় এনে আর্থিক সহায়তা দিলে সব খাত যখন চাঙ্গা হবে, তখনই বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। তদুপরি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভোগব্যয়ের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল। ভোগব্যয় বাড়াতে হলে ক্রেতাশ্রেণির হাতে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বিশাল এক কর্মিবাহিনী। ইতিমধ্যে অনেকেই আয়ের সংস্থান না থাকায় শহর থেকে গ্রামমুখী হয়েছেন। অসংগঠিত খাতের ত্রাহি অবস্থা। সব দিক বিবেচনা করেই সরকারের প্রণোদনার সুবিধা প্রদান করা উচিত। কিন্তু অনেক খাতই রয়ে গেছে প্রণোদনার বাইরে। এমনকি স্বল্প সুদের ঋণসহায়তার যে ঘোষণা এসেছে, সেটিও উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন না। এই সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়টি নির্ভর করছে ব্যাংকের খেয়ালখুশির ওপর। প্রাথমিকভাবে বড় প্রভাবশালীরাই প্রণোদনার সুবিধা পাচ্ছেন। ছোট ও মাঝারি মানের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোতে কোনো রকম সহায়তা পাচ্ছেন না। অনেকেই হয়রানির অভিযোগ করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাহকদের বলেই দিচ্ছেন যে প্রণোদনার সুবিধা সবাই পাবেন না। এখানে ব্যাংক যাদের ওপর সন্তুষ্ট শুধু তাদেরই দেওয়া হবে। মানে ব্যাংকের পরিচালকেরা যাদের নাম বলবেন, তারাই প্রণোদনার আওতায় ঋণসহায়তা পাবেন। সরকারঘোষিত এই প্যাকেজ বিতরণেও ব্যাংকের পরিচালকদের পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করছে কারা পাবেন, কারা পাবেন না। এর বাইরে ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের অবস্থা আরো খারাপ। তারা ব্যাংকের দ্বারস্থ হতেই পারছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কারা প্রণোদনার আওতায় ঋণসহায়তা পাচ্ছেন, তা তদন্ত করলে দেখা যাবে প্রভাবশালীরাই সুযোগটি নিচ্ছেন। অথচ যারা সত্যিকারেই অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছেন, যাদের ওপর ভর করে অর্থনীতি এগোচ্ছে, সেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বঞ্চিত হচ্ছে। একইভাবে বিগত দিনে গড়ে ওঠা বিশাল ভোক্তাশ্রেণির জন্যও কোনো সুখবর নেই। বাড়িভাড়া, স্কুল খরচ, দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের মতো অবস্থা হারিয়ে ফেলছেন অনেকেই। বিভিন্ন গবেষণায়ও বলা হয়েছে, নতুন করে ৩ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমায় চলে এসেছে করোনার কারণে। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তাশ্রেণির হাতে অর্থ সরবরাহের কোনো উদ্যোগ নেই।
প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ১৯টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই ৭৬ হাজার কোটি বা চার ভাগের তিন ভাগ অর্থ বিতরণ করা হবে। অর্থাত্, এই প্রণোদনা দেওয়ার মূল দায়িত্বই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর। প্যাকেজ ঘোষণার কয়েক মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো ঋণই দিতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অজুহাত দিচ্ছে যে ঋণের আবেদন যাচাইবাছাই করতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলেই ঋণ দেওয়া হবে। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, আশ্বাস দিতে দিতে তো শিল্পই শেষ হয়ে যাবে। এখন টাকার প্রয়োজন। এই ক্রান্তিকালে ব্যাংকগুলোর বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ঋণসহায়তার অর্থ দ্রুত বিতরণ করা উচিত। একই সঙ্গে কোনো পক্ষই যাতে বঞ্চিত না হয়, সেই ব্যবস্থাও নিতে হবে। যেমনটি ধনী দেশগুলো এমনকি পাশের দেশ ভারতেও করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকেই প্রাধান্য দিয়ে উত্পাদক, ভোক্তা সবার হাতে নগদ অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেসব দেশে। অথচ বাংলাদেশে এখনো সেই রকম সার্বজনীন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বড় তথা প্রভাবশালীরা বরাবরই ব্যাংক থেকে নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন। ঋণপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে সুদ মওকুফ, ঋণ ফেরতে ৩০ বছর পর্যন্ত বর্ধিত সময়, খেলাপি হলেও মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে নিয়মিতকরণসহ নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু ছোট ও মাঝারিরা সব সময়ই বিপাকে। ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে গিয়ে নিজেরাই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। অথচ সারা বিশ্বে এই ছোটদের, মাঝারিদের অনেক কদর। এদের এগিয়ে নিলে অর্থনীতি এগোবে, অন্যথায় নয়।