অর্থনীতি ও সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিশ্ব প্রতিযোগিতা সূচকে আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্ট বা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৯-এ বিশ্বের ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১০৫তম, গত বছর যা ১০৩তম ছিল। দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবসহ নানা কারণে বাংলাদেশের এই অবনতি হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিশ্বব্যাপী ডব্লিউইএফের এ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ১৯৭৯ সাল থেকে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশকেও এই রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই থেকে সিপিডি বাংলাদেশে সংস্থাটির সঙ্গে অংশীদার হিসেবে কাজ করে আসছে। প্রতিযোগিতার স্কোর নির্ধারণে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম, অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা, পণ্য বাজার, আর্থিক ব্যবস্থা, বাজারের আকার, ব্যবসায়িক গতিশীলতা ও উদ্ভাবনী সক্ষমতা- এই ১২টি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশের ওপর একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে সিপিডি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় এ বছর সুশাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেদন তৈরিতে যেসব ব্যবসায়ীর মতামত নেওয়া হয়েছে তাদের ৭৮ শতাংশ বলেছেন, সরকারি কাজ পেতে ঘুষ দিতে হয়। একইভাবে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে ঘুষ দিতে হয় বলে ৭৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মত দিয়েছেন। অংশগ্রহণকারী ৭৪ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, কর পরিশোধে ঘুষ দিতে হয়। ৭৭ শতাংশ ব্যবসায়ীর মত হচ্ছে- রাজনীতিবিদদের নৈতিক অবস্থানে অবক্ষয় হয়েছে। দুর্নীতি বৃদ্ধির ফলে ব্যবসার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। বিশেষ করে নতুন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েছেন বেশি। এছাড়া দুর্নীতির কারণে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে।
৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকারি তহবিলের যথাযথ ব্যবহার না হওয়া একটি সাধারণ প্রবণতা। বিচার ব্যবস্থা প্রভাবমুক্ত নয় বলে মনে করেন ৬৬ ভাগ উত্তরদাতা। ঘুষের মাধ্যমে বিচারিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা যায় বলে মনে করেন ৬৩ ভাগ উত্তরদাতা। মেধা সম্পদের সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল বলে মনে করেন ৭৩ ভাগ উত্তরদাতা ব্যবসায়ী। বিরোধ নিষ্পত্তিতে পর্যাপ্ত বিচার ব্যবস্থা নেই বলে মনে করেন ৬১ ভাগ উত্তরদাতা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকার বাজেটে যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তা সব খাত সমানভাবে পাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাব ও অনিয়মের কারণে এমন পক্ষপাতমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সরকার নতুন যেসব নীতি গ্রহণ করছে তার প্রশংসা করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সেসব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মতামতের প্রতিফলন হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, অবকাঠামোতে উন্নয়ন হলেও রেল যোগাযোগ এখনও আগের অবস্থায় রয়ে গেছে। সড়ক, নৌ ও আকাশপথের যোগাযোগ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প (ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট) সময়মতো শেষ না হওয়ায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সময়মতো এবং মানসম্মতভাবে প্রকল্প শেষ হওয়ায় নতুন প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্কোর গত বছরের মতো এ বছরও ৫২ দশমিক ১ রয়েছে। যদিও ১২টি মানদণ্ডের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় খারাপ করেছে। পণ্য বাজার ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি হয়েছে। শুধু ‘বাজার’ মানদণ্ডে বাংলাদেশ ৫০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে, সূচকের মানদণ্ডগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য, দক্ষতায় বাংলাদেশের উন্নতি হলেও প্রতিষ্ঠান, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও পণ্য বাজার পরিস্থিতিতে স্কোর কমেছে। অবকাঠামো, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শ্রমবাজার, আর্থিক ব্যবস্থা, বাজারের আকার, বাজারের গতিশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতায় এবার স্কোর হয়েছে গতবারের সমান।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার, নতুন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, দক্ষতা ও ব্যবসার গতিশীলতার বিষয়ে সতর্ক হওয়া দরকার বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, এসব বিষয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশেষ করে মানব সম্পদের ক্ষেত্রে। বর্তমানে যে মানব সম্পদ রয়েছে এবং আগামীতে যে মানব সম্পদ শ্রমবাজারে যোগ হবে, তাদের সময়োপযোগী দক্ষ করে তুলতে না পারলে এসব মানুষ দেশের বোঝা হয়ে যাবে। এজন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা তথা মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশ ক্রমাগত উন্নতি করলেও অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা বাড়ানো ও মানব সম্পদের উন্নয়ন করা দরকার। তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে অভ্যন্তরীণ বাজার কতিপয় ব্যবসায়ীর হাতে আটকে যায়নি। এখানে ছোট ব্যবসায়ীর সুযোগ থাকতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে।
আর্থিক পরিস্থিতি :প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত তার দুর্বল কাঠামোর সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এ খাতের সব সূচকই নেতিবাচক। যেসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার ৫৫ ভাগ ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এসএমই খাতের অর্থায়নে সুযোগ কমেছে। এছাড়া এ খাতে সুদের হারও বেড়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল অডিট ও রিপোর্টিং এখন দুর্বল। বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগেও নানা ধরনের বাধা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, অশুল্ক্ক বাধা বেড়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বরং দেশের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসার প্রবণতা বেড়েছে।
ঝুঁকি :বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধরনের কিছু ঝুঁকি দেখা দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বেকারত্ব বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা কার্যক্রমে দুর্বলতা, মনুষ্য সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি ইত্যাদি। গত এক বছরে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, সামাজিক অস্থিরতা, অবৈধ ব্যবসা ও সম্পদ বৃদ্ধিও নতুন ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। যদিও প্রতিবেদনে কিছু ঝুঁকি প্রশমিত হয়েছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ সময়ে সাইবার ঝুঁকি কমেছে বাংলাদেশে। অত্যন্ত বিরূপ আবহাওয়ার শিকার হয়নি। সন্ত্রাসী হামলা, পানি সংকট ও তথ্য চুরির মতো ঘটনা ঘটেনি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো দুর্বলতাও অনেকটা দূর হয়েছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি :বিশ্বে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক দিয়ে এবারের সূচকের শীর্ষে উঠে এসেছে সিঙ্গাপুর। এশিয়ার এই দেশটির স্কোর ৮৪ দশমিক ৮। এরপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্ক। এই দশটি দেশই গতবারের সূচকে শীর্ষ দশে ছিল, এবার শুধু অবস্থানের হেরফের হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, জাপান ও যুক্তরাজ্যের অবস্থার অবনতি হয়েছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত। ৬১ দশমিক ৪ স্কোর নিয়ে ভারত আছে সূচকের ৬৮ নম্বরে। তবে গতবারের চেয়ে ১০ ধাপ অবনমন ঘটেছে দেশটির। শ্রীলংকা ৫৭ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে সূচকের ৮৪তম, নেপাল ৫১ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে ১০৮তম এবং ৫১ দশমিক ৪ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান সূচকের ১১০ নম্বরে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার উন্নতি হয়েছে। এবার ভিয়েতনাম ১০ ধাপ এগিয়ে ৬৭টিতে আর কম্বোডিয়া ৪ ধাপ এগিয়ে ১০৬-এ উঠেছে। সিপিডি বলেছে, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।