স্মার্টফোন তৈরির জন্য নারায়ণগঞ্জে কারখানা স্থাপনের অনুমোদন নেওয়া হয়। একই সঙ্গে নেওয়া হয় স্মার্টফোনের কাঁচামাল আমদানির অনুমতি ও অনাপত্তিপত্র। কিন্তু সেই কারখানার ভেতরে পাওয়া গেল ক্যাসিনো খেলার সরঞ্জাম। ক্যাসিনোর অত্যাধুনিক টেবিল, যা ‘মাহাজং’ নামে পরিচিত। নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় বেস্ট টাইকুন (বিডি) নামে এই কারখানায় শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের একটি দল অভিযান চালায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর। অভিযানে পাওয়া যায় ক্যাসিনো দুনিয়ায় জনপ্রিয় এই মাহাজং।
চীন ও হংকংয়ের ক্যাসিনোগুলোতে জনপ্রিয় এই মাহাজং আমদানি করা হয়েছে মূলত মোবাইল ফোন কারখানার যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল হিসেবেই। যদিও পণ্য খালাসের সময় কাস্টমসের কাছে দেওয়া ঘোষণায় এ পণ্যের নাম ‘মাহাজং’ই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এটি ছিল মোবাইল ফোন সংযোজন কারখানার যন্ত্রপাতির তালিকায়। যদিও মাহাজং কোনোভাবেই মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ব্যবহার হয় না। এই মাহাজং ঘিরেই রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রযুক্তিপণ্যের আড়ালে আর কী কী আসছে দেশে। স্মার্টফোন কারখানার জন্য যন্ত্রপাতি আমদানির নামে এ ধরনের অবৈধ পণ্য আনা হলে প্রযুক্তিপণ্যে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর যে জয়যাত্রা, তা-ও প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআই) মুখপাত্র মনিরুল বাশার জানান, এই সংগঠনের সদস্য কোনো ধরনের অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরই মধ্যে এ জন্য কারণ দর্শাতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ভিভো মোবাইল কোম্পানি (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব ব্যবসায়ী আমদানির ক্ষেত্রে আইন অমান্য করছেন, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরাবরও একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক জানিয়েছেন, কেউ আইন অমান্য বা বিটিআরসির নীতমালার শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
যে অভিযানে ধরা পড়ল ‘মাহাজং’ :নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় বেস্ট টাইকুন (বিডি) নামে এই কারখানায় শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের অভিযানে পাওয়া যায় ক্যাসিনো সরঞ্জাম ‘মাহাজং’ টেবিল। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই কারখানায় উৎপাদন হওয়ার কথা চীনের ‘ভিভো’ ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন। স্মার্টফোন দুনিয়ার পরিসংখ্যান দাতা প্রতিষ্ঠান কাউন্টার পয়েন্টের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ মুহূর্তে চীনের ভিভো বিশ্বজুড়ে ৮ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে। যদিও এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় নয় এখনও।
ভুলতায় ওই অভিযানে কাউকে আটক করা হয়নি। এর কারণ হিসেবে শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যেহেতু ওই কারখানায় ‘মাহাজং’ ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, সে কারণে নিয়ম অনুযায়ী কাউকে গ্রেফতার বা আটক করা হয়নি। এই পণ্য আমদানির বিষয়টি আরও অধিকতর তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আর অভিযান পরিচালনার দিন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক শামীমা আখতার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তারা এ অভিযান পরিচালনা করেছেন। অভিযানের সময় তারা ‘মাহাজং’ নামে ক্যাসিনো সরঞ্জাম পেয়েছেন। এটি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনের কাঁচামাল নয়। কর ফাঁকি দিতেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এ পণ্য আমদানি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৬ মে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এই ‘মাহাজং’ খালাস করা হয়। এ জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে দাখিল করা বিল অব এন্ট্রিতে পণ্যটির নাম ‘মাহাজং’ উল্লেখ ছিল। এটি ছিল স্মার্টফোন তৈরির জন্য কাঁচামাল বা যন্ত্রপাতির তালিকায়; যেহেতু আমদানি-নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ‘মাহাজং’ বলে কিছু নেই। একই সঙ্গে এটি মোবাইল কারখানার যন্ত্রপাতির তালিকায় ছিল, সে কারণেই এটি খালাস করা হয়। এর মূল্য দেখানো হয় প্রায় ২৬ হাজার মার্কিন ডলার। মমতা ট্রেডিং কোম্পানি নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্সি পণ্যটি খালাস করে।
ভিভো ও বেস্ট টাইকুন :অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিভো স্মার্টফোন বাংলাদেশে রফতানি করে ‘কালার টাইকুন গ্লোবাল’ নামে একটি চীনা কোম্পানি। এই কোম্পানির পণ্য ক্রয় করে ভিভো মোবাইল কোম্পানি (বিডি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই ভিভো মোবাইল কোম্পানির (বিডি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক চীনা নাগরিক বাওহুয়া দু। তবে ভিভো স্মার্টফোনের কারখানা স্থাপনের জন্য যে কোম্পানি গঠন করা হয়, তার নাম দেওয়া হয় ‘বেস্ট টাইকুন (বিডি)’। সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সাধারণত আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী যে কোম্পানি হ্যান্ডসেট উৎপাদন করে, তারাই দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন দেশে রফতানি করে। কিন্তু চীনা একাধিক কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে কোম্পানি মোবাইল ফোন উৎপাদন করে, তারা রফতানি না করে দায়িত্ব এড়িয়ে তৃতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য রফতানি করে। এসব কোম্পানি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। যেমন বাংলাদেশে শুধু ভিভো নয়, চীনা অপো ব্র্যান্ডের স্মার্টফোনও আমদানি করা হয় ‘সিনসিয়র ওয়ার্থ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মোবাইল ফোন আমদানিকারকদের সংগঠন বিএমপিআই থেকে বিটিআরসিতে জমা পড়া অভিযোগে প্রমাণসহ ভিভো ও অপোর রফতানিকারকের বিরুদ্ধে অভিনব কৌশলে বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকির তথ্য দেওয়া হয়েছিল।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, ভিভো টেকনোলজি ও অপো ইলেকট্রনিকস করপোরেশন দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান হলেও এ দুটি প্রতিষ্ঠানই চীনের বিবিকে ইলেকট্রনিকসের অধীন প্রতিষ্ঠান। বিবিকে ভিভো ও অপো ছাড়াও ওয়ান প্লাস, রিয়েল মি নামে ব্র্যান্ডের স্মার্টফোনও বাজারজাত করে। অর্থাৎ, চীনের একটি কোম্পানির ছাতার নিচেই গড়ে উঠেছে একাধিক ব্র্যান্ড। বিবিকের সদর দপ্তর চীনের ডংগুয়ানে অবস্থিত, আর মূল কারখানা গুয়াংজুতে।
সর্বশেষ কারখানা থেকে ক্যাসিনো সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে ভিভো বাংলাদেশের কর্মকর্তা তানজীব আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রশ্নগুলো ই-মেইলে পাঠাতে বলেন। প্রশ্ন ই-মেইলে পাঠিয়ে একদিন অপেক্ষা করার পর আবারও যোগাযোগ করলে তিনি এ ব্যাপারে জানতে ভিভো বাংলাদেশের গণসংযোগের দায়িত্বে থাকা একটি সংস্থার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ওই সংস্থার একজন কর্মকর্তা পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বেস্ট টাইকুন (বিডি) নামে এই কোম্পানির সঙ্গে কারখানা স্থাপনের জন্য ভিভো বাংলাদেশ যুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়নি। এর বেশি আর কোনো তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান।