ইট-পাথরের এই ঢাকা শহরে সবুজায়ন আর অক্সিজেনের জোগান দিতে ছাদবাগান গড়ায় উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব নেই। সিটি করপোরেশন থেকেও এ রকম ছাদবাগান করার জন্য বলা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে প্রণোদনা। বাড়ির বারান্দায় টবে লাগানো হচ্ছে নানাবিধ ফুল, ফুল ও সবজি গাছ। এ ব্যাপারে নগরবাসীর সচেতনতাও বেড়েছে। কিন্তু অতিযত্নে গড়ে তোলা সৌন্দর্যের এ বাগানই সামান্য অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে এডিস মশার উৎপাদনস্থল। আর এই মশা এখন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পরিণত হয়েছে নগরবাসীর অন্যতম আতঙ্কে।
সম্প্রতি দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ড্রোনের মাধ্যমে চালিত জরিপে রাজধানী ঢাকার মাত্র তিন এলাকাতেই এমন কিছু ফুলের টব, ছাদবাগান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, টায়ার, পরিত্যক্ত পলিথিন, মগ, বালতিসহ নানা পাত্র পাওয়া গেছে, যেগুলো এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র। সংখ্যাটিও যেনতেন নয়, ৩০ হাজার ১৯১। এর মধ্যে ফুলের টবই আছে ২৪ হাজার ২১৬টি।
পরিবেশবাদীরা অবশ্য এ জরিপের পর অন্য আশঙ্কা করছেন। তাদের মতে, এই জরিপের মাধ্যমে ছাদবাগান নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে কোনো ভুল তথ্য গেলে সেটা হবে ক্ষতিকর।
তারা বলেন, এডিস মশা দমনের নামে কোনোভাবেই ছাদবাগান ধ্বংস করতে দেওয়া যাবে না। গুরুত্ব দিতে হবে বাগান পরিস্কার করার ক্ষেত্রে। তাদের পরামর্শ- ছাদ বা বারান্দায় টবের নিচের প্লেট সরিয়ে রাখতে হবে। কার্যকর রাখতে হবে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা। তারপরও গাছের গোড়ায় পানি জমলে দ্রুত সেটা অপসারণ করতে হবে। এটা করা গেলেই ছাদবাগানে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থাকবে না।
ছাদবাগান জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে শাইখ সিরাজ বলেন, ছাদবাগান আমাদের উপকার করে, অপকার না। যে ছাদবাগান করে না, তার ছাদেও তো লার্ভা পাওয়া গেছে। এর মানে হলো, সমস্যাটি ছাদবাগানে না, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাই ফ্যাক্টর। কেউ যদি ছাদবাগান করতে গিয়ে ওপরে নানারকম পাত্র ফেলে আর খোঁজ না নেয়, সেই দায় ছাদবাগানের ওপর যায় না।
সরকার ছাদকৃষি প্রমোট করছে জানিয়ে তিনি বলেন, শুধুমাত্র ছাদকৃষিতেই জাপানের টোকিওর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে। ঢাকা শহরেও এটি খুবই জরুরি। এ জন্য নানা প্রকল্পের আওতায় কাজ চলছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন। যারা ছয় মাস একবারও ছাদে যায় না, তারা প্রকৃতপক্ষে কৃষিপ্রেমী না।
ড্রোন উড়িয়ে তোলা ছবি বিশ্নেষণে এডিসের সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র পাওয়ার যে দাবি করছে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সে বিষয়েও জোরালো আপত্তি জানান তিনি।
শহরবাসীর অক্সিজেন জোগাতে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করে থাকে বাংলাদেশ গ্রিন রুফ মুভমেন্ট নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. গোলাম হায়দার বলেন, একসময় আমরা মানুষকে বলতাম যে, ‘ছাদে বাগান করুন।’ এখন আমাদের বলতে হবে, ‘শুধু বাগান নয়, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন-পরিকল্পিত বাগান করুন।’
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অভিযানেও দেখা গেছে, প্রতি ১০টি ছাদবাগান ও ফুলের টবের মধ্যে অন্তত দুটিতে এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। ছাদ সবুজায়ন করে নিয়মিত আর যত্ন নেওয়া হয়নি। ফলে ছাদ হয়ে উঠেছে স্যাঁতসেঁতে, অপরিচ্ছন্ন। বহু স্থানে জমাট স্বচ্ছ পানি, যা এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উর্বরক্ষেত্র। ডিএনসিসির ৫৪ শতাংশ বাড়িতে এ রকম পরিবেশ দেখা গেছে। ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ বাড়িতে মিলেছে লার্ভাও।
ডিএনসিসির অঞ্চল-১-এর নির্বাহী কর্মকর্তা জুলকার নাইন বলেন, এমনও অনেক বাড়ির ছাদ দেখেছি, যেখানে কোনো একসময় বাগান করা হয়েছিল; অথচ এরপর আর পরিচর্যাই করা হয়নি। অনেকরকম পাত্র পড়ে রয়েছে, যেখানে কয়েকদিনের পানি জমে আছে। বিশেষ করে দুই বাড়ির মাঝখানে এবং অনেক বাড়ির বেজমেন্টে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার লার্ভা বেড়ে উঠছে।
তিনি বলেন, সবুজায়ন করতে গিয়ে যদি এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র বানানো হয় তাহলে সেটা দুঃখজনক।
ডিএনসিসির প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন জানান, ২৫ আগস্ট থেকে টানা ১০ দিনে ৩৬টি ওয়ার্ডে সব মিলিয়ে এক লাখ ছয় হাজার ৯৮২টি বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করে এক হাজার ৮৯৩টি বাড়ি ও স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ৫৮ হাজার ১৫টি বাড়ি ও স্থাপনায় এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী স্থান বা জমে থাকা পানি পাওয়া যায়। সেসব স্থান ধ্বংস করে লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হয়।
ডিএনসিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, বনানী ও বাড্ডা এলাকায় সর্বাধিক এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ছাদবাগান প্রকল্পে নিযুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে প্রায় পাঁচ লাখ ছাদবাগান রয়েছে। সাধারণত দুই-তিনটি গাছ থাকলেও সেটি ছাদবাগান বলে গণ্য করা হয়।
২০১ একরে ৫৩৪৭ সম্ভাব্য এডিস প্রজননক্ষেত্র :রাজধানীর মিরপুর, কমলাপুর এবং নারিন্দা এলাকায় ড্রোন উড়িয়ে তোলা ছবি পর্যবেক্ষণ করে এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে দুটি বেসরকারি সংস্থা। জরিপের রিপোর্টটি এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০১ একর আয়তনের তিনটি এলাকায় এডিস মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে পাঁচ হাজার ৩৪৭টি। এসব এলাকায় থাকা বাড়ির ছাদগুলোতে দেখা যায় পানিভর্তি নানারকম পাত্র। ফুলের টব, টায়ার, এসির জমাট পানিসহ ৩০ হাজার ১৯১টি স্থান।
রোগ নিরীক্ষণ কার্যক্রমে ভূতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রুপ ম্যাপারস জরিপটি করেছে। আর, ড্রোন পরিচালনার কাজটি করেছে ইগলেক্স নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
গ্রুপ ম্যাপারসের গবেষক ও মানচিত্র বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সাজিদ ইবনে জামান বুধবার জানান, ড্রোনের মাধ্যমে নেওয়া অন্তত ৭০০টি ছবি পর্যালোচনা করে তারা একটি সিদ্ধান্তে আসেন। মিরপুরে ৫৫ একরের জরিপে ২ হাজার ৭৫৮টি, কমলাপুরে ৩৩ একরে ১ হাজার ৫৫৯টি এবং নারিন্দায় ১১৩ একরে ১ হাজার ৩০টি এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল রয়েছে।
তার দাবি, তিনটি এলাকার ছবি পর্যালোচনা করে পানির ১৮২টি খোলা ট্যাঙ্ক ও ৪৫টি পানি সংরক্ষণাগার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ২৪ হাজার ২১৬টি ফুলের টব, এক হাজার ৯৮টি এসি, এক হাজার ৬১৪টি পরিত্যক্ত পলিথিন, ৭৩২টি টায়ার এবং বালতি, মগসহ নানা ধরনের কৌটা দেখা গেছে দুই হাজার ২৯৪টি।
জরিপে তথ্যটি পাওয়ার কথা স্বীকার করে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, অনেক বাসায় ফুলের টব ও ছাদের ওপরে গড়া বাগানে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র উপযোগী পরিবেশও পাওয়া গেছে। এডিস মশার বংশ ধ্বংস করার জন্য গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া উচিত। এ ছাড়া নির্মাণাধীন মেট্রোরেল ও ভবন, বৃহৎ স্থাপনা এমনকি চিড়িয়াখানায় পর্যন্ত এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার তথ্য দেন তিনি।
গবেষক সাজিদ বলেন, ‘কেউ যদি দুই-তিন দিনের জন্য ঢাকার বাড়ি থেকে বাইরে থাকেন, তাহলে ওই বাড়ির ছাদে বা সংশ্নিষ্ট বাসায় থাকা টব প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ছাদের ওপর অরক্ষিত অবস্থায় যেসব ফুলের টব এবং নানারকম পাত্র পড়ে আছে, সেখানকার মধ্যে একটি পাত্রেও যদি এডিস মশা বংশবিস্তারের সুযোগ পায়, তাহলে সেটি পুরো এলাকার মানুষকে আক্রান্ত করার জন্য যথেষ্ট।
বুধবার রাজধানীর কমলাপুর ও নারিন্দা এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় পানি নিস্কাশনের ড্রেনগুলোর অধিকাংশই জলাবদ্ধ। টিপু সুলতান রোডের ১৮/বি নম্বর প্লটের বাড়ির ওপরে রয়েছে অপরিচ্ছন্ন ছাদবাগান। একই সড়কের ২০/২ নম্বর হোল্ডিংয়ের আলম ভিলার ওপরে কয়েকটি টবে গাছ লাগানো হয়েছিল। সেখানেও দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যা হয়নি।