ঢাকার হাজারীবাগ থেকে পাঁচ বছর আগে যে শিশুকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগে এক নারীসহ চারজনের বিচার একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল সেই আবু সাঈদ আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজেই জানালো, ‘পড়ালেখা ভালো না লাগায়’ পালিয়ে গিয়েছিল সে।
সেই সময়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আবু সাইদ এখন ১৫ বছরের কিশোর। বৃহস্পতিবার তাকে ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে হাজির করা হয়।
বিচারক বেগম শাসসুন্নাহারের প্রশ্নে আবু সাঈদ জানায়, কেউ তাকে অপরহরণ করেনি। সে নিজেই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল।
আবু সাঈদের বাবা মোহাম্মদ আজম, মা মাহিনুর বেগমকেও এদিন কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছিল। ছেলের অপহরণের মামলা করে এখন তারা নিজেই প্রতারণা মামলার আসামি।
২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল আবু সাইদ হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে হাজারীবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন আজম। ওই জিডির পর তিনি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির মামলা করেন।
সেই মামলায় বিভিন্ন সময়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়, শিশুটিকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে বরিশালের হিজলার বাসিন্দা সোনিয়া আক্তার, তার ভাই আফজাল, ফুপাতো ভাই সাইফুল এবং আত্মীয় শাহিন রাজিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে হাজির করা হলে আফজাল ও সাইফুল ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
তাদের দুজনের দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে ডিবি সে সময় জানায়, শিশুটিকে বরিশালগামী লঞ্চ থেকে মেঘনা নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। তদন্ত শেষে ওই চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন ডিবির এসআই রুহুল আমিন।
এরপর গত পাঁচ বছর সেই মামলার বিচার চলে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এ। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ৫ সেপ্টেম্বর দিন রাখেন বিচারক।
কিন্তু তার আগেই হাজারীবাগ থানা পুলিশের এক তদন্তে জানা যায়, শিশুটিকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনাটি সাজানো, শিশুটি বেঁচেই আছে।
সোনিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, আবু সাঈদকে তারা চেনেন না। তারপরও তাকে এবং তার ভাই, বাবা ও প্রতিবেশীকে গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. রুহুল আমিন।
আদালতে ওঠানোর আগে প্রায় ৮ দিন তাদের ‘মিথ্যা স্বীকারোক্তির জন্য নির্যাতন’ করার অভিযোগ করে তিনি বলেন, জবানবন্দি না দিলে তার বাবাকেও মামলায় জড়ানোর ‘ভয় দেখানো হয়’। বাধ্য হয়ে তার ভাই আফজাল ও সাইফুল আদালতে ‘পুলিশের শেখানো স্বীকারোক্তি’ দেন।
এ মামলায় ছয় মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান সোনিয়া। ২০১৫ সালে শুনতে পান আবু সাঈদ নামের সেই শিশু বেঁচেই আছে, তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর তিনি সাঈদের বাবার সঙ্গে আপসের চেষ্টা করেন। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য সবাই মিলে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন মামলার বাদী আজমকে।
এরপর আরও দুই লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে পল্লবীর একটি বাসায় আবু সাঈদকে নিয়ে যেতে বলেন তিনি। সেই টাকা নিতে গত ২৯ অগাস্ট ওই বাসায় গিয়ে পুলিশের হাতে ছেলেসহ ধরা পড়েন আজম, তার স্ত্রী মাহিনুর ও সাঈদের ফুফা আব্দুল জব্বার।
তাদের বিরুদ্ধে সোনিয়া প্রতারণা মামলা করলে সেই মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে হাজারীবাগ থানা পুলিশ। তবে তাদের কেউ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি।
বৃহস্পতিবার আবু সাঈদ ও তার বাবা-মাকে আদালতে হাজির করার পর আদালতের প্রশ্নে আজম স্বীকার করেন, এই সেই আবু সাঈদ, যে হারিয়ে গিয়েছিল।
বিচারক বেগম শাসসুন্নাহার তখন বলেন, এই আবু সাঈদ যে, মামলায় বর্ণিত সেই ‘নিহত’ আবু সাঈদ, তা পুলিশ প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে হবে।
২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগ থানাকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়ে বিচারক বলেন, ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আদেশ দেবেন তিনি।
রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী আলী আসগর স্বপন। আর সোনিয়াদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির এসআই (বর্তমানে ডেমরা থানায়) রুহুল আমিন নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে। সেইই মাস্টারমাইন্ড ছিল। রুহুল আমিন এবং তার পেছনে যারা কলকাঠি নেড়েছে, তাদের বিচার চাই।”