ঘূর্ণিঝড় ফণী অতি প্রবল থেকে দুর্বল হয়ে বাংলাদেশে ঢোকায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে বলে সরকারের ধারণা, তবে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনও মেলেনি।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণী ভারতের ওড়িশায় তাণ্ডব চালিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে শনিবার সকালে বাংলাদেশে ঢোকার পর দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে রূপ নিয়েছে।
এরপর আবহাওয়া অধিদপ্তর সমুদ্র বন্দরগুলোর বিপদ সঙ্কেত নামিয়ে নিতে বলার পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিপদ কেটে গেছে।
এই সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, মুখ্যসচিব নজিবুর রহমানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন, তাদের মুখে ছিল স্বস্তির ভাব।
ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ায় লন্ডনে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন বলে তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়।
বিপদ সঙ্কেত নেমে গেলেও বন্দরে স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত রয়েছে; সারাদেশে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়াও বয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ২-৪ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘর ও গাছচাপা পড়ে নয়জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধিরা।
তবে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নিহতের সংখ্যা চারজন বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এরা আশ্রয় কেন্দ্রে যাননি। আহতের সংখ্যা ৬৩ জন বলে জানান তিনি।
ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল সরকার; শুক্রবার বিকালের মধ্যে ১৯টি জেলার মানুষকে ৪ হাজারের বেশি আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এনামুর রহমান জানান, ১৬ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
বিপদ কেটে যাওয়ার পর শনিবার বিকাল থেকে নিজেদের ঘরে ফিরতে শুরু করে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া মানুষগুলো।
ফণীর প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ায় দুই সহস্রাধিক ঘর উড়ে গেছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য সমন্বিত করে দেখা যায়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।
তবে তিনি বলেন, ঝড়টি দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং আগাম প্রস্তুতি থাকায় ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্যোগ মোকাবেলায় গৃহীত সার্বিক প্রস্তুতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দলের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হবে।
“যে পরিবারের যতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠার জন্য সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তা দেওয়া হবে। পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”
নৌবাহিনী জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ফণী পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় দূর্গত এলাকায় জরুরি উদ্ধারকাজ, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও চিকিৎসা সহায়তা শুরু করেছে তারা। তিনিটি জাহাজ শনিবার সকালেই রওনা হয়েছে তিন দিকে।
দুর্গত এলাকাগুলোতে নৌবাহিনী জাহাজগুলো জরুরি ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও খাবার স্যালাইন বিতরণের কাজ করছে।
ঝড়ের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ারে পটুয়াখালীতে বেশ কিছু পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে তিনটি উপজেলার অন্তত ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়ে তলিয়ে যায় বাড়িঘর, ফসলি জমি। বাগেরহাটের শরণখোলার তিনটি গ্রামও প্লাবিত হয়।
এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বেড়িবাঁধ ভাঙা বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর নিতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। এর টেলিফোন নম্বর ০২৯৫৪০৭০১। এটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে বলে জানানো হয়েছে।
ঝড়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন কৃষকরা মাঠের বোরো ধান নিয়ে; পরিপক্ক হয়ে ওঠা ধান আর সপ্তাহখানেক পরই কাটার কথা।
ঝড়ে কী পরিমাণ বোরো ধাণের ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া না গেলেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী দুদিন আগে জানিয়েছিলেন, ১১ হাজার হেক্টর জমির ধান ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঝড়ে কী পরিমাণ বিদ্যুতের খুঁটি উপড়েছে কিংবা লাইনের কেমন ক্ষতি হয়েছে, তা জানা যায়নি।
তবে গ্রামীণফোন জানিয়েছে, ঝড়ের কারণে ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, এবং চট্টগ্রামে তাদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কোম্পানিটি বলেছে, “মোবাইল নেটওয়ার্ক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল হওয়ার বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা খুব দ্রুত পুনঃস্থাপন দরকার। এ লক্ষ্যে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যৌথভাবে কাজ করছি।”
বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে এলেও ভারতের ওড়িশা উপকূলে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়েই এক দিন আগে আঘাত হেনেছিল ফণী। তাতে রাজ্যটির বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে বলে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে। ফসলেরও বেশ ক্ষতি হয়েছে ওড়িশা ও অন্ধ্র প্রদেশে।