ফরিদপুরে বাবর যুগের অবসান

image-528997-1646855042

খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। ২০০৭ সালে নিজের এলাকা কৈজুরীতে ছোট্ট একটি মুরগির ফার্ম গড়ে মুরগি ও ডিমের ব্যবসা শুরু করেন।

২০০৮ সালে বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মন্ত্রী হন।

এরপরই মোহতেশাম হোসেন বাবরের উত্থান ঘটতে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যে মুরগি ব্যবসায়ী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান।

শুধু বিপুল সম্পদ অর্জন নয়, ভাইয়ের আশীর্বাদে ফরিদপুরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির নীতিনির্ধারক বনে যান বাবর।

তার কথায় সেসময় প্রশাসন থাকত তটস্থ। তিনি যা বলতেন, প্রশাসন তাই করত। বাবরের বিরোধিতা তো দূরের কথা, কেউ তার অপকর্ম নিয়ে কথা বলতে সাহস পেতেন না। হোক সেটা গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে। ‘হাতুড়ি’ আর ‘হেলমেট’ বাহিনী দিয়ে শায়েস্তা করা হতো বিরোধীদের। টেন্ডার থেকে শুরু করে হাটবাজারের ইজারা, বালু ব্যবসা, বিভিন্ন কাজের পার্সেন্টেজ, নিয়োগ বাণিজ্যসহ এহেন কোনো অফিস নেই যেখান থেকে টাকা তুলতেন না বাবর ও তার বাহিনী। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পর্দা কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়ক এই বাবর।

বড় ভাই ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৮ সালে মন্ত্রী হন। এরপর থেকেই ভাইয়ের সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব পান বাবর। বিভিন্ন স্থানের সভা-সমাবেশে খন্দকার মোশাররফ হোসেন ছোট ভাই ‘বাবর’কে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘আমার অবর্তমানে রাজনীতিসহ সবকিছুই দেখবে বাবর।’

এরপর থেকেই বিস্ময়কর ও অভাবনীয় উত্থান ঘটে বাবরের। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাজ বাবরের নির্দেশ ছাড়া কেউ পেতেন না। তিনি ফরিদপুরে ‘মিস্টার ১৫ পার্সেন্টেজ ম্যান’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপের কারণে ফরিদপুরের মানুষ তাকে ‘সম্রাট বাবর’ হিসাবে ডাকতেন। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়তার সুযোগ নিয়ে ফরিদপুরের মানুষকে রীতিমতো জিম্মি করে রেখেছিলেন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। সোমবার ফরিদপুর পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর পতন ঘটে ‘বাবর যুগের’। তার পতনে উল্লাসে মেতে উঠে ফরিদপুরবাসী। আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণও হয় বিভিন্ন স্থানে।

২০১০ সালে বাবর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হন। এরপর তিনি ফরিদপুরের ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়ে ব্যাপকভাবে তৎপরতা শুরু করেন। ২০১৪ সালে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই সময়ে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মাহাবুবুল হাসান ভুইয়া। তিনি অভিযোগ করেন, বাবর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আমার বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। সে সময়ে হাজারো সাধারণ মানুষ বাবরের এহেন অপকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে বিচার চেয়েছিলেন। আল্লাহ সেই অসহায় মানুষের প্রার্থনা শুনেছেন।

বাবর ২০১৫ সালে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন। তার অপকর্মের কারণে অতিষ্ঠ ছিলেন ফরিদপুরের অন্য আসনের সংসদ-সদস্য এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। তার থেকে বয়সে বড় এবং কেন্দ্রীয় নেতাদেরও তিনি পরোয়া করতেন না।

নানা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া বাবরের অঢেল সম্পদের খোঁজ পায় গোয়েন্দা সংস্থা। ফরিদপুর শহরের অদূরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক বাড়ি করেছেন তিনি। এছাড়া নিজ এলাকা কৈজুরীসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে হাজার বিঘা জমি। ঢাকায় কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ায় বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাবর নিজস্ব বলয়ে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে হাতুড়ি ও হেলমেট বিশেষ বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনী দিয়ে হেন কাজ নেই তিনি করাননি। জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকে তার বাহিনী প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করেছে। এ নিয়ে কেউ মামলার কথা চিন্তাও করতে পারেননি। তার মতের বিরোধীদের দমন করেছেন নানাভাবে নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে। বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টাকা দিতে গড়িমসি করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠাতে দ্বিধা করতেন না বাবর। তিনি বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের পুনর্বাসিত করেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদ দিয়ে।

বাবরের বিরুদ্ধে ফরিদপুর নিউমার্কেটের নতুন ভবন নির্মাণের কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। শুধু টাকা নিয়েই ক্ষান্ত হননি, যারা দীর্ঘদিন মার্কেটে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, তাদের হটাতে মামলা দিয়ে, পুলিশ দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। সেই নির্যাতন এবং দোকান হারিয়ে অনেকেই মারা যান। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোটি টাকার পর্দা কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়কও বাবর। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।

বাবর ও তার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা জানার পর প্রধানমন্ত্রী ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৯ সালে ফরিদপুরে শুদ্ধি আভিযান চলে। সেই অভিযানে একে একে ধরা পড়েন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। এরপর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান মোহতেশাম হোসেন বাবর। ফরিদপুর থেকে গোপনে ঢাকায় পাড়ি জমান বাবর। বেশ কিছুদিন বিদেশেও ছিলেন। ২০২০ সালের ২৬ জুন দুই হাজার কোটি টাকা অর্থ পাচার মামলায় নাম আসে বাবরের। মামলায় বাবরসহ ১০ নেতার নামে ঢাকার সিআইডি মামলা করে।

২০২১ সালের ৩ মার্চ মোহতেশাম হোসেন বাবরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি

। ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস।

সম্প্রতি আদালত চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ৮ মার্চ পুলিশ মোহতেশাম হোসেন বাবরকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। আর এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে রাজনৈতিক দানব হিসাবে পরিচিত ‘বাবর যুগের’।

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাব বোস বলেন, বাবর ছিলেন ফরিদপুরের রাজনৈতিক দানব। এই দানবের অপকর্মের কারণে ফরিদপুরবাসী অতিষ্ঠ ছিল।

তার পতন হওয়ায় এ জনপদের মানুষ উল্লসিত। জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি শামীম হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে এহেন কোনো অপকর্ম নেই যা মোহতেশাম হোসেন বাবর করেনি। বাবর গ্রেফতার হওয়ায় ফরিদপুরের মানুষ আনন্দ মিছিল করেছে। মিষ্টি বিতরণ করেছে। তার কঠিন শাস্তি হোক-এটা দেখতে চায় ফরিদপুরবাসী।

Pin It