টেলিকম খাতে কাউকে দানব হতে দেওয়া হবে না মন্তব্য করে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেছেন, “যারা চেষ্টা করবে, প্রয়োজনে পাখা কেটে দেওয়া হবে।”
দেশব্যাপী ফাইবার অপটিক কেবল সেবাদাতা এনটিটিএন অপারেটরদের সেবা নিয়ে নিজেদের অসন্তুষ্টি তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেরাই আবার ফাইবার কেবল স্থাপনে অনুমতি পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো।
সোমবার এক গোলটেবিলে বৈঠকে টেলিযোযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছে ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার সেই দাবি আবারও তুলে ধরেছে মোবাইল অপারেটররা।
বৈঠকে উপস্থিত ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) এনটিটিএন অপারেটররা এর বিরোধীতা করে বলেছে, কমন নেটওয়ার্ক ছাড়া খরচ কমানো সম্ভব নয়। বিটিআরসির নীতিমালায় কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে, যেগুলো সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিৎ।
রাজধানীর একটি হোটেলে টেলিযোগাযোগ বিটের প্রতিবেদকদের সংগঠন টিআরএনবি আয়োজিত ‘আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের গুরুত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিষয়টি সামনে আসে।
এতে বক্তব্য রাখেন মোবাইল অপারেটর রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের প্রতিনিধিরা। পাশাপাশি নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন এনটিটিএন কোম্পানি ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ ও ‘সামিট কমিউনেকশন্সে’র প্রতিনিধিরা।
মোবাইল ফোন অপারেটর ও এনটিটিএনগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের প্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারী বলেন, “মোবাইল অপারেটর এবং এনটিটিএন দুইজনের ওপর আস্থা রেখেই দেখেছি, ফল আসেনি। কেননা মোবাইল অপারেটররা একটা সুইট পয়েন্ট মিস করেছে। ডেটা রেভ্যুলেশনে তারা এখন ডিজিটাল সেবাদাতা হিসেবে পরিচিত হতে চায়। ইন্টারনেটের দাম জলের দামে নেমে না আসলে এটা সম্ভব হবে না। এজন্য নেটওয়ার্ক সাসটেইন করতে হবে।”
মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ব্যান্ডউইথ পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ফাইবার অপটিক কেবল। ২০০৯ সালের আগে মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেরাই এই ফাইবার স্থাপন করেছে, কেউ রেলের ফাইবার ব্যবহার করেছে।
এরপরে সরকারের সিদ্ধান্তে ফাইবার কেবল স্থাপনের জন্য এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন থেকেই ফাইবার কেবলগুলোর নিয়ন্ত্রণ পায় এনটিটিএন কোম্পানিগুলো। এখন দেশে সরকারি তিনটি ও বেসরকারি তিনটি এনটিটিএন রয়েছে। তবে বাজারে ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ এবং ‘সামিট কমিউনিকেশন্সে’র আধিপত্য রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার এসব কোম্পানিকে ’অনৈতিকভাবে’ বাড়তি সুযোগ দিয়েছে কি না সে বিষয়টিও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে। তবে এনটিটিএন কোম্পানিগুলো সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মোবাইল অপারেটরগুলো সেবার ক্ষেত্রে ত্রুটি ও উচ্চ মূল্যের জন্য এনটিটিএনগুলোকে অভিযুক্ত করে আসছে।
এর বিপরীতে এনটিটিএন অপারেটরদের যুক্তি ‘কমন নেটওয়ার্ক’ স্থাপনের ফলে ডেটার দাম কমানো সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি মোবাইল অপারেটর পৃথকভাবে ফাইবার বসালে তাতে খরচ বাড়বে, জটিলতাও বাড়বে।
সংশিষ্টরা বলছেন, মোবাইল অপারেটরগুলো এনটিটিএন এর কাছে ফাইবার ভাড়া নিতে (ডার্ক ফাইবার) চায়। আর এনটিটিএনগুলো চায় পরিবহন করা ব্যান্ডউইথের পরিমাণ অনুযায়ী দাম নিতে। এ নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে বসে এর সুরাহা করতে পারছে না।
সোমবারের গোলটেবিলে মোবাইল অপারেটর রবির চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার সাহেদুল আলম অভিযোগ তোলেন, “এখন পর্যন্ত দুটো এনটিটিএন অপারেটর আমাদেরকে কিন্তু ফাইবার দেয় না। এনটিটিএন’র যে মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ফাইবার দেওয়া হবে সেটা কিন্তু তারা দিচ্ছে না। যার কারণে আমরা সাফার করছি প্রতিনিয়ত। এখন ফাইবার অ্যাট হোম রাজি হয়েছে ডার্ক ফাইবার দিতে। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে।
“আমরা যাচ্ছি একদিকে, এনটিটিএন অপারেটররা যাচ্ছে একদিকে। আমাদের থিংকিং প্রসেসের কোথাও মিল হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমরা দেখি ভিডিওর চাহিদা বাড়ছে ৩০ গুণ বেশি। নন ভিডিও অ্যান্ড টু অ্যান্ড কমিউনিকেশন বাড়বে ৪৭ গুণ। আমরা এর জন্য প্রস্তুত, অবশ্যই না।”
তার ভাষ্য, এখন নানা কারগরি কারণে তিনটি এনটিটিএন অপারেটরের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে কোনো প্রতিযোগিতা নেই এবং সেখানে মানসম্পন্ন সেবার কোন প্রশ্নও কেউ তুলছে না। কেবল মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রেই মান সম্পন্ন সেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
”এর কারণে আমরা মানুষের কাছে তাদের প্রত্যাশিত দামে মান সম্পন্ন সেবা দিতে পারছি না।“
বৈঠকে উপস্থিত বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে সাহেদুল বলেন, “আমরা কিন্তু বলছি না আপনি এনটিটিএন অপারেটরদের বন্ধ করে দেন। আমরা মনে করি এনটিটিএন অপারেটররা আমাদের সহযোগী। আমরা যেটা বলব, মোবাইল অপারেটরদের যেমন রেস্ট্রিকশন দেওয়া আছে, এনটিটিএন অপারেটরদের যেমন রেস্ট্রিকশন দেওয়া আছে এই সমস্ত রেস্ট্রিকশনগুলো তুলে দেওয়া হোক। সব প্লেয়ারকে ওপেনলি বিজনেস ও ইনভেস্ট করার সুযোগ দেওয়া উচিৎ।
”এইসব রেস্ট্রিকশন তুলে দিয়ে প্রতিযোগিতা তৈরি করুন, যা একটা গ্লোবার ইকোনমির জন্য প্রয়োজন। ওপেন হয়ে গেলে আমরা ফাইট করব বেশি।”
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন আমাদের সামনে একটা লাইফটাইম অপরচুনিটি তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে যদি আমরা এটা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) করতে না পারি আমরা এই সুযোগ হারাব। এখানে কোনো পলিটিক্যাল প্রভু (মাস্টার) নেই, আমাদের বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে এখন কোন রাজনৈতিক মাস্টারকেই খুশি করতে হবে না।”
পরে সামিট কমিউনেকশন্সের চিফ নেটওয়ার্ক আর্কিটেক্ট ফররুখ ইমতিয়াজ বলেন, “২০০৯ সালে এনটিটিএনগুলোকে সেবা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা কী ধরনের সেবা দিতে পারব তা এই ২০২৪ সালে এসেও সুনির্দিষ্ট হয়নি। আমরা ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোভাইডার হিসেবে আইএসপি বা অন্য যারা ইউজার আছেন তাদের কী ধরনের সার্ভিস দিতে পারবো সেখানে একটা গ্রে এরিয়া বা কনফিউশন আছে।
”আবার (মোবাইল অপারেটরগুলোকে) এনটিটিএন কী সেবা দিবে এটা আসলে ডার্ক ফাইবার মিন করে, না এটা ক্যাপাসিটি বেইজড সার্ভিস মিন করে বিটিআরসির গাইডলাইনে এগুলো ক্লিয়ার না। এই জায়গা থেকে বিটিআরসি যদি কোন ক্লিয়ার দিক নির্দেশনা দেয় তাহলে আমরা অবশ্যই সেটা ফলো করব।”
তার ভাষ্য, “আমরা যখন বিজনেস শুরু করি তখন বড় যে অপারেটরগুলো ছিল তাদের হাতেই এই ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কটা কুক্ষিগত ছিল। এবং তখন এক এমবিপিএস (ডেটার) দাম ছিল ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এখন সেই পরিমাণ ডেটার দাম আসলে এটা ৫০ টাকারও কম।”
অবকাঠমো ব্যবসায় চুক্তির ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়ার গুরুত্ব দিয়ে ফররুখ ইমতিয়াজ বলেন, “যখন টাওয়ার ব্যবসার সুযোগ সামনে এলো তখন বিটিআরসি একটা লকিং পিরিয়ড দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে ২০০৭ সালে যখন এনটিটিএন গাইলাইনটা করে সেখানে এরকম কোন লকিং ছিল না। ইনফ্রাস্ট্রাকচার বিজনেসে রিটার্ন আসে লং টার্মে।“
তার আশা বিটিআরসি এই সময়সীমাটা (লকিং) সুনির্দিষ্ট করে দিলে দাম অনেক কমিয়ে দেওয়া সম্ভব।
বাংলালিংকের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান তাইমুর রহমান বলেন, “মোবাইল অপারেটর, এনটিটিএনসহ সবারই ফাইবার ডেপ্লয় করার সুযোগ থাকা উচিৎ। আমাদের যখন একটা বেইজ স্টেশন (টওয়ার) থেকে আরেকটা স্টেশনে জরুরি ভিত্তিতে ফাইবারের প্রয়োজন হয় তখন এটার জন্য কেন আমাদের আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে। এটা কিন্তু অনেক ডিলে হয়ে যায়। এটা একটা সমস্যা।”
মোবাইল কোম্পানি কেন টাওয়ার রাখতে পারবে না সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এই বিষয়গুলো রিভিউ করা উচিৎ। ফাইবারাইজেশন বাড়ানোর জন্য বা আমি যদি আরও তাড়াতাড়ি ডেপ্লয় করতে চাই তাহলে কেন পারবে না। এগুলো তো আমার ব্যবসার কাঁচামাল।”
এনটিটিএন কোম্পানি ফাইবার অ্যাট হোমের চেয়ারম্যান ময়নুল হক সিদ্দিকী বলেন, “১৬ বছর ধরে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে কমন নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করছে এনটিটিএন। আইএসপিরা যেন তৃণমূলে ইন্টারনেট নিয়ে যেতে পারে সে জন্য আমরা কাজ শুরু করি। সবগুলো উপজেলায় নেটওয়ার্ক নিয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন কাজ। এখন মনে হচ্ছে সব সমস্যার গোড়া এনটিটিএন।
“আমরা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে থাকতে চাই। এজন্য আমরা বারবার অপারেটরদের সঙ্গে বসেছি। এরপরও আমি উত্থাপিত সব প্রশ্নেরই লিখিত উত্তর দিতে পারব। একসঙ্গে কাজ করলে সল্যুশন আসবে। কমন নেটওয়ার্কের কারণে ট্রান্সমিশন খরচ ১০০ ভাগ কমানো সম্ভব হয়েছে।”
সভায় বিটিআরসির চেয়ারম্যান এমদাদুল বারী বলেন, “আজকের দিনে ইন্টারনেট মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত। কখনোই ইন্টারনেট বন্ধ হওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যবসা সুরক্ষায় নয় সেবার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে রেফারির দায়িত্ব পালন করবে বিটিআরসি।”
টেলিকম খাতে কাউকে দানব হতে দেওয়া হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যারা চেষ্টা করবে, প্রয়োজনে পাখা কেটে দেওয়া হবে।”
নেটওয়ার্ক আলাদা করার ধারণা থেকে এনটিটিএনগুলোর জন্ম মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু এখন এনটিটিএনকে সমস্যা হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।… ইন্টারনেটের কেন্দ্রে রয়েছে এনটিটিএন। সেজন্য সরকার সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। তারা কোথাও মাত্রা ছাড়িয়েছে কিনা তা দেখা যেতে পারে। ১০ বছরে তারা উপজেলা হেড কোয়ার্টারে পৌঁছেছে। কিন্তু এই পৌঁছানোর ধরনটা কী? অভিযোগ উঠেছে পর্যাপ্ত পপ নেই।”
ব্রডব্যান্ডকে সমাধান হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “এজন্য আমরা একটি ব্রডব্যান্ড পলিসি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। টেকনোক্রাট হিসেবে বলতে পারি আমাদের ডার্ককোরের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এটার প্রাপ্যতা নিয়ে মোবাইল অপারেটররা সামনের দিনে সংকটে পড়বে। তাই আমাদের টেকসই পথ খুঁজতে হবে।
ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ’থার্ডপার্টির’ কাছে দেওয়া দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, ”পাশাপাশি ইন্টারনেট সেবা ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করতে হবে যাতে তরুণরা ঝাঁকে ঝাঁকে অংশ নিতে পারে। সেবাকে টেকসই, সাশ্রয়ী করতে যা করার আমরা তাই করব।”