বর্ষা মৌসুমের শেষ সময় ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের সব কয়টি গেট খুল দেওয়ায় গঙ্গা প্রবাহের পানি আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের অংশ পদ্মায়। ভারতের উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হওয়ায় উপচে পড়ছে বাঁধের পানি। এ কারণে ফারাক্কা ব্যারাজের ১১৯টি গেট একযোগে খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এতে পদ্মায় আকস্মিক পানি বেড়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঈশ্বরদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে মঙ্গলবার ১৬ বছর পর পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উপজেলার দুই ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। এ উপজেলার চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৩৮ গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। আগের দিন সোমবার বিকেলে ফিলিপনগর ও মরিচা ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় বাড়িঘরে পানি ঢুকে যাওয়া মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে রাজবাড়ী পয়েন্টেও। ফলে সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ঈশ্বরদী (পাবনা): পাবনা পাউবো হাইড্রোলজি বিভাগের উত্তরাঞ্চলীয় নির্বাহী প্রকৌশলী কেএম জহুরুল হক জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি বেড়েছে ১৪ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে। এ কারণে ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা ও সাহাপুর ইউনিয়নের ৫-৬টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। চরকুড়ূলিয়া, সাহাপুর, মাধপুর, কামালপুর, কৈকুণ্ডা, লক্ষ্মীকুণ্ডা গ্রামের বসতবাড়িও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ১ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ এ প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে বলেন, পদ্মার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার আগে থেকেই তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও কৃষকদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। দুপুর পর্যন্ত পদ্মার পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, যে কোনো সময় পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সাহিদুল ইসলাম জানান, দুপুর ১২টা পর্যন্ত পদ্মা নদী বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার এবং মহানন্দা ৩৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ দু’টি নদীর বিপৎসীমা যথাক্রমে ২২ দশমিক ৫০ ও ২১ সেন্টিমিটার।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক একেএম তাজকির-উজ-জামান জানান, বন্যাকবলিত দুই উপজেলার মানুষের জন্য সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ে শুকনো খাবারের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
কুষ্টিয়া ও দৌলতপুর: পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলায় নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেড় হাজারের অধিক পরিবারের বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৩৮ গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তলিয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল। সোমবার বিকেলে ফিলিপনগর ও মরিচা ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ পেরিয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। এলাকাবাসী বালির বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
কুষ্টিয়ার পাউবো সূত্রে জানা গেছে, পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার পানি বাড়ছে। সর্বশেষ পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রধান শাখা গড়াই নদীতেও অব্যাহতভাবে পানি বাড়ছে। মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় গড়াইয়ের পানি প্রবাহিত হচ্ছিল ১২ দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পীযূষ কৃষ্ণ কুণ্ডু বলেন, এ মুহূর্তে পদ্মার পানি বিপৎসীমার কয়েক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পর ভেড়ামারা উপজেলার মোসলেমপুরে পানি ঢুকছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া শহর, কুমারখালী ও খোকসার কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করে ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে পারে।
মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ আলমগীর জানান, তার ইউনিয়নের ভুরকা এলাকায় স্লুইস গেট ভেঙে পদ্মার পানি প্রবেশ করায় বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দুপুরে বন্যাকবলিত রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন স্থানীয় এমপি অ্যাডভোকেট আ.কা.ম. সরওয়ার জাহান বাদশা ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন। তারা বন্যাদুর্গত ১৫শ’ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।
জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে প্রতি ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের একাধিক টিম ঘটনাস্থলে আছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রস্তুত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিনিয়ত রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। আশা করি, বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।
রাজশাহী ও বাঘা: পানিতে থইথই করছে উঠান, বারান্দা। আঙিনায় বইছে স্রোত। ঘরের ভেতর বুকপানি। পানিতে ভিজে গেছে চাল-ডাল, বিছানা-বালিশ। ঘর থেকে ভেজা কাপড়ে আসবাবপত্র ও সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে এলেন ভানু বেগম। ঘরের বাইরে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছেন স্বামী লিটন শিকদার। পদ্মার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বসতঘরে পাঁচ দিন ধরে বন্দি থাকার পর নৌকায় অন্যত্র আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন তারা।
মঙ্গলবার দুপুরে পানিবন্দি লিটন-ভানু দম্পতির মতো রহিমা বেগম, সিদ্দিক, কমেলা, আজিজালসহ অনেকেরই দুর্ভোগের এ চিত্র দেখা গেছে রাজশাহীর চকরাজাপুর ইউনিয়নের পদ্মার চরে। এই ইউনিয়নের চৌমাদিয়া, আতারাড়া, দিয়াড়কাদিরপুর, পলাশিফতেপুর, নীচপলাশি, দাদপুর, লক্ষ্মীনগর. চকরাজাপুর, কালিদাশখালীসহ ১৫টি গ্রামের কয়েকশ’ বসতবাড়ি তলিয়ে গেছে। বিকেল ৩টায় পদ্মার পানি রাজশাহীতে বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পাউবো রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল আলম জানান, শহর রক্ষা বাঁধের ভেতরে পানি ঢোকার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে বাঁধের বাইরে নদীর ভেতরে তালাইমারিসহ শহরের কিছু এলাকায় থাকা বস্তিতে পানি উঠেছে। পরিবারগুলো বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, নদীকে তার স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত হতে দেওয়া উচিত। ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে এখন নিজেরাই ডুবে মরছে। তাদের এই চরম বিপদের সময়ে ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ায় আমরাও বিপদে পড়েছি। এই বাঁধের কারণে আমাদের দেশের শত শত নদীর চিহ্ন এখন হারিয়ে গেছে। এখন হঠাৎ ধেয়ে আসা পানি এই নদীগুলো আর নিতে পারছে না।
রাজবাড়ী: জেলা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ভাগ্যকুল পয়েন্টে পদ্মার পানি ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে বিপৎসীমার লেভেল ৮ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার। প্রবাহিত হচ্ছে ৮ দশমিক ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।
তিনি জানান, পানি বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আগামী তিন-চার দিন পানি আরও বাড়তে পারে। তবে পানি বাড়লেও স্রোতের গতি কমে গেছে। ফলে নদীভাঙনের আশঙ্কা নেই।
জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম জানান, তারা ইউএনও ও পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। পরিস্থিতি নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির জন্য সংশ্নিষ্ট ইউএনওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।