জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি ও কূটনীতিকরা।
শুক্রবার লন্ডনে এক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সভায় তারা এই প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ হাই কমিশন ও International Maritime Organistion (IMO)-এর যৌথ উদ্যোগে এই আলোচনা সভা হয়।
ভার্চুয়াল সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ.কে. আব্দুল মোমেন।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং আইএমওতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি সাইদা মুনা তাসনীমের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার হিসেবে আইএমও-এর সেক্রেটারি জেনারেল কিটাক লিম এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে কমনওয়েলথ-এর সেক্রেটারি জেনারেল পেট্রেসিয়া স্টকল্যান্ড বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে ভারত, জাপান, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সৌদি-আরব এবং সেন্ট কীটস ও নেভিস-এর রাষ্ট্রদূত ও আইএমও-এর স্থায়ী প্রতিনিধিসহ যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস এবং যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল কমিটি ফর ইউনেস্কোর প্রধান নির্বাহী বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে বসবাসকারী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ প্রবাসী বাংলাদেশিরা অংশ নেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ.কে. আব্দুল মোমেন বলেন, ছেচল্লিশ বছর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। এই ভাষণের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক সুসম্পর্ক, বিশ্বশান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিরও মূলভিত্তি।
তিনি আরো বলেন, ছেচল্লিশ বছর পর বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তখন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য ও দূরদর্শী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করেই জাতিসংঘের অন্যতম সদস্য হিসেবে বিশ্বের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতির মতোই এই নেতার প্রাগ্রসর সমুদ্র নীতিমালা অনুসরণ করেই বাংলাদেশ আইএমও-এর সাথে বলিষ্টভাবে কাজ করে চলেছে।
সূচনা বক্তব্যে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ আজও প্রখ্যাত ‘মেঘনা কার্টা’র মতো বাংলাদেশের কূটনৈতিক আদর্শ ও কর্মধারার দিক-নির্দেশনা হয়ে আছে। যার ভিত্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আর্থিক সমতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার।
আইএমও-তে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে হাইকমিশনার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় বাংলাদেশের মেয়েরা আজ বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক জাহাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছে। এর মাধ্যমে আইএমও-এর জেন্ডার সমতার লক্ষ্যই পরিপূর্ণ হচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মহামারির সময়ে সমুদ্রে আটকেপড়া নাবিকদের প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে এবং তাদের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হাইকমিশনার কোভিডের কারণে বিভিন্ন দেশের সমূদ্রসীমায় আটকেপড়া প্রায় আট হাজার নাবিক, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাবিকরাও রয়েছেন, তাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। সেই সাথে সমুদ্রে আটকেপড়া বাংলাদেশি নাবিকদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেয়ার জন্য আইএমও-এর সদস্য দেশগুলির প্রতি আহবান জানান।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে আইএমও-এর সেক্রেটারি জেনারেল কিটাক লিম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আত্মত্যাগ করে গেছেন।
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশ আজ তারই নেতৃত্বে আইএমও-তেও বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে এবং সমুদ্র নীতিমালা ও এর যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নীত করেছে।
কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল পেট্রেসিয়া স্টকল্যান্ড বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন দূরদর্শী ও সফল নেতা ছিলেন। তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছেন গণতন্ত্র, শান্তি, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। আর এসবই হচ্ছে কমনওয়েলথের মৌলিক আদর্শ।
তিনি ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, কমনওয়েলথই হচ্ছে প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন যা বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে সদস্য দেশের মর্যাদা দেয়।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল কমিটি ফর ইউনেস্কোর প্রধান নির্বাহী জেমস ব্রিজ বলেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত যে অসাধারণ ও সফল কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন তারই ঐতিহাসিক দলিল হচ্ছে ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে তার এই অনন্য বক্তৃতা।
জেমস ব্রিজ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কথাও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণ করেছে।
যুক্তরাজ্যের এফসিডিও-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রধান ফারগুস অল্ড ওবিই বলেন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ অর্জন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যেরও বলিষ্ঠ সমর্থন ছিলো। তিনি জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি গৌরবের বিষয় বলে উল্লেখ করেন।
ফারগুস অল্ড বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিবেশ পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য ও সক্ষমতা অর্জন করেছে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আইএমও-এর স্থায়ী প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এবং জাতিসংঘে তার ভাষণের ৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ শ্রদ্ধা জানান।
রাষ্ট্রদূত ও আইএমও-এর স্থায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার গায়ত্রি ইসার কাউর, নেদারল্যান্ডের এম্বাসেডর কেরল ভ্যান ওস্টেরম, জাপানের এম্বাসেডর ইয়াসুমাসা নাগামিন, নরওয়ের এম্বাসেডর ওয়েগের স্ট্রমেন, দক্ষিণ আফ্রিকার হাইকমিশনার নমেটেম্বা গুগুলেথু পুডনিক্সিয়া অলিভিয়া ট্যাম্বু, কেনিয়ার হাইকমিশনার সেলেব মানোয়া ইসিপিসু, সেন্ট কীটস্ ও নেভিস-এর হাইকমিশনার ড. লেভম ওসাক, আইএমও-তে সৌদি আরবের স্থায়ী প্রতিনিধি ইসাম মো. আলমারি এবং মালয়েশিয়ার ম্যারিটাইম এ্যাটাসী ক্যানাগালিংগম টি সেলভারাসাহ।