আজ ১৮ ডিসেম্বর ‘সুপ্রিম কোর্ট দিবস’। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর তৎকালীন প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার সভাপতিত্বে উভয় বিভাগের বিচারপতিগণের ফুল কোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী যেহেতু ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রথম কার্যক্রম শুরু করেছিল, সেহেতু প্রতি বছর ঐ দিনটিকে বাংলাদেশ ‘সুপ্রিম কোর্ট দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। সেই থেকে ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৮ ডিসেম্বর ’৭২ দিনটি ছিল সরকারি ছুটি। কিন্তু তত্কালীন প্রধান বিচারপতি ঐ দিন ছুটি প্রত্যাহার করে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের ‘দৈনিক কার্যতালিকা (কজ লিস্ট)’ প্রণয়ন করেন এবং ঐ তারিখ থেকে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসার পরদিন অর্থাত্ ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ ‘দি প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ অর্ডার, ১৯৭২’ জারি করা হয়। ঐ আদেশের অনুচ্ছেদ ৯-এ উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশে একটি হাইকোর্ট থাকবে, যা একজন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতি যারা সময়ে সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
ঐ দিনেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান। ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ রাষ্ট্রপতির ৫ নম্বর আদেশ অর্থাত্ ‘দ্য হাইকোর্ট অব বাংলাদেশ অর্ডার, ১৯৭২’ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হাইকোর্ট। স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের গোড়াপত্তন এভাবেই। রাষ্ট্রপতির ১১৪ নম্বর আদেশ অর্থাত্ দ্য হাইকোর্ট অব বাংলাদেশ (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) আদেশ দ্বারা রাষ্ট্রপতির ৫ নম্বর আদেশের কার্যকারিতা দেওয়া হয় ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে। ১৬ আগস্ট ’৭২ বাংলাদেশ হাইকোর্টের আপিল বিভাগ গঠন এবং এর কার্যক্রম শুরু হয়।
১৮ ডিসেম্বর ’৭২ সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে। ভাষণ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, আইনজীবীসহ উপস্থিত সুধীবৃন্দের উদ্দেশে। বক্তব্যের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামে জীবন ও আত্মত্যাগকারী আইনজীবীসহ সবার প্রতি। তিনি বলেছিলেন, ‘যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের সুপ্রিম কোর্ট, আজ আমাদের দেশে আইনের শাসন হতে চলেছে, তাদের আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন।’
বঙ্গবন্ধু সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে শহিদ আইনজীবীদের নামফলক দেখতে না পেয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে, ‘আমি নিশ্চয়ই সুখী হতাম, যেমন পি জি হসপিটালে গিয়ে দেখি যে, এত জন ডাক্তারের নাম, যারা শহিদ হয়েছে। তাদের নাম লেখে ফলক করে রাখা হয়েছে। আমি সুখী হতাম বারের সদস্য ভাইয়েরা, যে যে সহকর্মীরা যারা শহিদ হয়েছেন—এই সুপ্রিম কোর্টের গেটে এসে দেখতে পেতাম যে শহিদের নাম সেখানে লেখা রয়েছে। বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনাদের আমি অভিযোগ করছি না।’
বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই অনেকে আমরা সংগ্রাম করেছি এবং এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেজন্যই শাসনতন্ত্র এত তাড়াতাড়ি দিয়েছিলাম। যদি ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা, যদি রাজনীতি করতাম আপনারা নিশ্চয়ই আমার পাশে যারা বসে আছেন জানেন যে, তালে তাল মিলিয়ে, গালে গাল মিলিয়ে বহুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। কিন্তু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই, রাজনীতি করেছিলাম মানুষের মুক্তির জন্য। সে মানুষের মুক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে যদি মানুষ তার শাসনতন্ত্র না পায়। আইনের শাসন না পায়।’
সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আইনের মধ্যে যদি গোলমাল হয়, সেখানে আপনাদের সংশোধন করার ক্ষমতা রয়েছে। মনে করেন তাতে পরিপূর্ণতা হচ্ছে না, আপনাদের ক্ষমতা রয়েছে নতুন আইন পাশ করা। এমন আইন পাশ করা উচিত হবে না দেশের মধ্যে রেশারেশি সৃষ্টি হয়।’
সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর মধ্য থেকেই যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত ও শাসনতন্ত্র প্রয়োগ করতে হবে, বঙ্গবন্ধু সে বিষয় সংশ্লিষ্ট সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আইনের শাসন করতে হলে, আমাদের শাসনতন্ত্রের মধ্যে যে মৌলিক জিনিস রয়েছে সেটাকে মেনে নিয়েই করতে হবে বলেই বিশ্বাস করি। আমি আইনজীবী নই, আপনারা আইনজীবী, আপনারা বুদ্ধিজীবী, আপনারা ভালো বুঝেন। আমি আইনজীবী কোনো দিন হতে পারি নাই, তবে আসামি হওয়ার সৌভাগ্য আমার যথেষ্ট হয়েছে জীবনে। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, দেশের শাসনতন্ত্রকে যাতে উপযুক্ত ব্যবহার করা হয়, সেদিকে আপনারা নজর রাখবেন। কারণ সে ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে আপনাদের দেওয়া হয়েছে। যে আইন শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে হবে, তার সম্পর্কে মতামত দেওয়ার অধিকার আপনাদের আছে, নাকচ করার অধিকার আপনাদের রয়েছে।
কিন্তু অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে যায়। সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমি আপনাদের অ্যাডভাইস দিতে চাই না, আপনারা এ জিনিসটা আমার চেয়ে অনেক ভালো বুঝেন।…। আইনের শাসন এদেশে হবে এবং আমাদের শাসনতন্ত্র যে হয়েছে, আমরা চেষ্টা করব সকলে মিলে চেষ্টা করব যাতে এটার যে আদর্শ দেওয়া হয়েছে আদর্শকে রক্ষা করা এবং এখানে সুপ্রিম কোর্টের অনেক দায়িত্ব রয়েছে এবং আপনাদের যে সাহায্য-সহোযোগিতা প্রয়োজন, আপনারা সেটা পাবেন।’
বঙ্গবন্ধু বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের কোনো কাজে আমরা ইন্টারফেয়ার করতে চাই না। আমরা চাই যে, দেশের আইনের শাসন কায়েম হউক।’ পাশাপাশি তিনি বিচার বিভাগকে দেশের মানুষের মানসিকতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘তবে একটা কথা আছে, দেশের অবস্থা আপনাদের বিবেচনা করে চলা উচিত। অনেক সময় যদি বেশি আপনারা করতে যান তবে দেশের মধ্যে যদি আইনশৃঙ্খলার খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়, তবে যেমন আমিও কষ্ট ভোগ করব, আপনিও কষ্ট ভোগ করবেন, সেদিকে আপনাদের খেয়াল রাখারও প্রয়োজন আছে।’
সংবিধানের স্কিম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার কোনো শাসনতন্ত্রেই খারাপ কথা লেখা নেই। কিন্তু সেটা যদি আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে কাজ করে এগিয়ে না যাই, তাহলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আমাদের শাসনতন্ত্র আমাদের আদর্শ আছে। যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। যেমন, চারটা স্তম্ভের উপরে এই দেশ; আমরা তাকে ফান্ডামেন্টাল রাষ্ট্র আদর্শ বলি। চারটা রাষ্ট্রীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই দেশ চলবে। এটাই হলো মূল কথা।’
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা যখন বলেন, আমরাও তখন বলেছি এবং আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, জুডিশিয়ারি সেপারেট হবে এক্সিকিউটিভ থেকে। অনেকে বলেন, কমপ্লিট সেপারেশন। কোনো রাষ্ট্রে কোনো কিছুই কমপ্লিট সেপারেশন হয় না। একই সঙ্গে একটা অন্যটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একই রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে যে অরগানগুলো থাকে, যেমন জুডিশিয়ারি একটি অরগান, যেমন এক্সিকিউটিভ একটি অরগান। এর মধ্যে যদি কোপারেশন না থাকে, তাহলে সে দেশের মধ্যে কেওয়াজ সৃষ্টি হয়, যে কেওয়াজের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালের পর থেকে আপনাদের যে দশা হয়েছিল, সে দশাই হবে।
একটার সঙ্গে অন্যটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু যার যার যেখানে ক্ষমতা রয়েছে সেটাকে নিশ্চই প্রতিপালন করবেন।…। কেউ কোনো দিন হস্তক্ষেপ করবে না আপনাদের অধিকারের উপরে। সে সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন এবং যতটা তাড়াতাড়ি হয় আমরা চেষ্টা করব যাতে জুডিশিয়ারি সেপারেটভাবে কাজ করতে পারে।’
মাতৃভাষা বাংলায় রায় লেখার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যে ইংরেজি ভাষায় অনেক কিছু আমাদের চলছে। ইংরেজি ভাষা আমাদের রক্তের মধ্যে কিছু কিছু আচরণ করেছে সন্দেহ নেই এবং ইংরেজি ভাষা আমাদের পরিভাষার প্রয়োজন সেটাও বুঝি, কিন্তু এ পরিভাষার জন্য যদি চিন্তা করি, হয়তো বাংলা ভাষা হবে না। সেজন্যই আমরা শাসনতন্ত্রে কোনো ভাষা মিডিয়া রাখি নাই, যে পাঁচ বত্সরে দশ বত্সরের মধ্যে বাংলা থেকে ইংরেজিতে পৌঁছতে হবে।
আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করুন। এভাবেই যা শেষ পর্যন্ত ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে।…। মাননীয় প্রধান বিচারপতি সাহেব, বেয়াদবি মাফ করবেন। এটা আমাদের, যা আমি দেখেছি, অনেক দেশে ঘুরেছি যারা তাদের অক্ষর পর্যন্ত নাই, তারা নিজের ভাষায় কথা বলে, নিজের ভাষায় লেখে এবং জাজমেন্ট দেয়।’
বঙ্গবন্ধু বক্তব্য শেষ করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই প্রত্যাশা নিয়ে, ‘এত বিপদ-আপদ, এত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের মধ্যে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এত তাড়াতাড়ি এজন্য দিয়েছি যে আইনের শাসনে বিশ্বাস করি এবং সেজন্য শাসনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে। আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আমাদের শাসনতন্ত্র হয়েছে যার জন্য বহু রক্ত গেছে, এদেশে আজ আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হয়েছে। যার কাছে মানুষ বিচার আশা করে।’
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। রক্তস্নাত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পালটে দেওয়ার জন্যই জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সাজা নিশ্চিত করে বিচার বিভাগ বঙ্গবন্ধুর সামান্য ঋণ শোধ করেছে মাত্র। রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রেখে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী দ্রুততার সঙ্গে বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর আহ্বান-প্রত্যয় বাস্তবায়ন, তার স্বপ্নসাধ পূরণ ও রক্তঋণ শোধ করার দায়ভার আজ সুপ্রিম কোর্টের ওপর।
লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ