বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে দুটির বদলে এখন থেকে একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করলে আদৌ এর কোনো কার্যকারিতা থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন এসেছে অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে।
তাদের ধারণা, বছরে একবার মুদ্রানীতি দেওয়া হলে তা হয়ত বাজেটের মধ্যেই হারিয়ে যাবে।
প্রতি অর্থবছরের শুরুতে সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে, তা অর্জনের জন্য এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে বাজারে টাকার সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করাই হল মুদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য।
আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মুদ্রানীতি ঠিক করে, যেখানে ঋণপ্রবাহ, আন্তঃব্যাংক ঋণের সুদহার এবং মুদ্রা বিনিময় হারকে সঠিক মাত্রায় রাখার চেষ্টা থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগেও এক সময় বছরে একবার মুদ্রানীতি দিত। ২০০৬ সাল থেকে অর্থবছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণার নিয়ম চালু হয়। মূলত এর পর থেকেই অর্থনীতির এই ‘পলিসি টুল’ নিয়ে বাংলাদেশে সাধারণের পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়।
কিন্তু বুধবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য আলাদাভাবে মুদ্রানীতি ঘোষণার ‘বিশেষ তাৎপর্য’ তারা আর দেখছেন না। সে কারণে এখন থেকে বছরে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান মনে করছেন, বছরে একবার হলে মুদ্রানীতি দেওয়া হলে এর কোনো কার্যকারিতাই হয়ত আর থাকবে না।
“মুদ্রানীতি কিন্তু কমিউনিকেশন টুল; এটা কিন্তু ফিসকাল টুল নয়। আমার মনে হয় এটি বছরে একবার করা হলে এর মূল শক্তিটা আর থাকবে না।”
সাবেক এই গভর্নরের মতে, সবচেয়ে ভালো হত যদি বছরে ছয় বার মুদ্রানীতি দেওয়া যেত।
“আমাদের দেশে তথ্য পাওয়া যায় না, তাই বছরে দুই বার করা হত। বছরে একবার হলে এটার সাথে বাজেটের আর পর্থক্য থাকবে না, পুরোটাই ফিসকাল পলিসি হয়ে যাবে, বাজেটের মধ্যে হারিয়ে যাবে।”
আর সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে স্বতন্ত্র গুরুত্ব, তাও অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন আতিউর রহমান।
তিনি বলেন, “ভারত প্রতি দুই মাস পর পর মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। মুদ্রানীতির প্রধান কাজ বিনিয়োগকারীদের মুদ্রাবাজরের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এটি বিনিয়োগকারীদের মুদ্রাস্ফীতি এবং বিভিন্ন আর্থিক সূচক সম্পর্কে একটি পূর্বাভাস দেয়।”
বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির বলেন, “প্রথাগতভাবে অর্থবছরের শুরুতে সমগ্র বছরের জন্য মুদ্রানীতি কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয় এবং মধ্যবর্তীকালে যে কোনো সময়ে নীতি সুদহার ও নগদ জমার/তারল্যের বিধিবদ্ধ হারসমূহকে প্রয়োজনসাপেক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়।
“সুতরাং অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য আলাদাভাবে মুদ্রানীতি ঘোষণা বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না।”
ড. সালেহ উদ্দিন গভর্নর থাকার সময় ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমবারের মতো অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এর আগে বছরে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা হত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে একমত নন।
তিনি বলেন, “মুদ্রানীতি একটা স্বল্প মেয়াদী পলিসি টুল। এটা বছরে দুই বার হওয়া ভাল। বাংলাদেশে এমনিতে মুদ্রানীতি তেমন কাজ করে না, মুদ্রানীতির লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয় না। কিন্তু মুদ্রানীতির কিছু সিগন্যালিং ইফেক্ট আছে। বছরে একবার হলে সেটাও আর থাকবে না।”
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুদ্রানীতি যদি বছরে একবারও প্রকাশ করা হয়, তাহলেও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে একটি ‘রিভিউ’ প্রকাশ করা উচিত্।
“না হলে অর্থনীতিতে তথ্যের অভাব দেখা দেবে এবং দিক-নির্দেশনার অভাব দেখা দেবে। মুদ্রানীতি বিশ্বের আনেক জায়গায় বছরে ৬ বার করে হয়।”
তবে গভর্নর ফজলে কবির এ বিষয়ে পাশে পাচ্ছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখতকে।
তিনি বলেন, বাজেটে জিডিপি বা মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় তা পুরো বছর অপরিবর্তিতই রাখা হয়। ফলে মুদ্রানীতি একবার ঘোষণা করলে সমস্য হওয়ার কথা নয়।
“বছরের প্রথম ৬ মাসে অর্থনীতির সূচক গুলোর তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। পরে দেখা যায় কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে যে কনো সার্কুলার দিয়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব।”