গত এক দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ হলেও সম্প্রতি অ্যাপারেল খাতে বাংলাদেশকে টপকে গেছে ভিয়েতনাম। গত অর্থ বছরের ১২ মাসে বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ভিয়েতনামের আয় এসেছে ৩০ বিলিয়ন ৯১ কোটি ডলার, যেখানে বাংলাদেশের এসেছে ২৭ বিলিয়ন ৯৫ কোটি ডলার।
অর্থাৎ ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে ৩ বিলিয়ন বা ২৯৬ কোটি টাকা বেশি। আর এর মাধ্যমে বিশ্ববাজারে শীর্ষ দ্বিতীয় অবস্থান থেকে হার মেনেছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’।
তবে এ খাতের রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভিয়েতনামের অ্যাপারেল রপ্তানির মধ্যে সু ও টেক্সটাইল একসাথে ধরা হয়, যেখানে বাংলাদেশের অ্যাপারেল রপ্তানিতে শুধু টেক্সটাইল খাতকেই বোঝানো হয়। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে গত দুই মাস (মার্চ-এপ্রিল) বন্ধ ছিল, যেখানে ভিয়েতনামের রপ্তানি চালু ছিল। বছর শেষে আবার ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ, এমনটাই দাবি তাদের।
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শক্ত প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। গত পাঁচ বছরে তারা ভালো অবস্থান তৈরি করেছে। দেশটি ইউরোপের সঙ্গে এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) করতে পারলে বাংলাদেশের মতো তারাও জিএসপি সুবিধা পাবে তারা, এতে তারা আরও এগিয়ে যাবে। তবে তাদের পেছনে ফেলতে উদ্যোক্তাদের পরিবর্তনশীল বাজারে টিকে থাকতে ক্রেতার চাহিদাকে মাথায় রেখে রকমারি পণ্য তৈরিতে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিয়ে দেশে টানতে হবে।
বিজিএমইএ’র তথ্য মতে, ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়) বিশ্ববাজারে ৯৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদশ। চলতি বছরের একই সময়ে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ১ হাজার ৫০ কোটি ৯১ ডলারের তৈরি পোশাক। গত পাঁচ মাসে বাংলাদেশের চেয়ে ৮২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি বেশি করেছে ভিয়েতনাম। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি পোশাক রপ্তানি করলেও মার্চ থেকে এগিয়ে ভিয়েতনাম। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে ১১২ কোটি ডলারের বেশি তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি করে।
মার্চে বাংলাদেশ ২২৬ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে একই মাসে ভিয়েতনাম করে ২৩৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি। এপ্রিলে বাংলাদেশ ৩৭ কোটি ডলার আর ভিয়েতনাম করে ১৬১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। আর মে মাসে বাংলাদেশ ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি করে যেখানে একই মাসে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ১৮৬ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতে, বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ আর ভিয়েতসামের ৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে চীন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয় কমেছে ১৮ দশকিম ১২ শতাংশ আর ভিয়েতনামের কমেছে ৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কারখানাগুলোতে সক্ষমতার মাত্র ৩৫-৪০ শতাংশ কার্যাদেশ রয়েছে। বর্তমানে বায়ারদের কাছ থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় ক্রয়াদেশ অনেক কম আসছে, যেটা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে রপ্তানি আয়ের বড় এ খাতকে অতীতের মতো সরকারের কাছ থেকে পলিসিগত সাপোর্ট আর নীতি সহায়তা প্রয়োজন, পাশাপাশি ইনসেনটিভ বাড়াতে হবে।
বিকেএমইএ’র পরিচালক ফজলে শামিম এহসান বলেন, গত পাঁচ বছরে ভিয়েতনামের অবস্থানের অনেক উন্নতি হয়েছে। তাদের পলিসিগত সাপোর্ট তাদের এগিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ইইউ বা ইউএস-এ মাল ডেলিভারি দিতে ১ মাস লাগে তাদের ১০-১২ দিনে হয়ে যায়। আমাদের ব্যবসায়ী সহজিকরণ সূচক কঠিন তাদের অনেক সহজ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর ফলে আমাদের দুই মাস পোশাক রপ্তানি বন্ধ ছিল, ভিয়েতনামে এমনটা ছিল না। তাদের অ্যাপারেল রপ্তানিতে সু এবং টেক্সটাইল আছে, আমাদের অ্যাপারেল রপ্তানিতে শুধু টেক্সটাইল ধরা হয়। আমাদের অর্ডার আসছে, গ্রোথ এখন ভালোর দিকে। পাঁচ মাসে তারা আমাদের থেকে এগিয়ে গেলেও বছর শেষে আমরা আবারও শীর্ষ দ্বিতীয় অবস্থান ফিরে যেতে পারব।
এ বিষয়ে গবেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আলী নূর বলেন, ভিয়েতনামে কাঁচামালের সরবরাহ, পণ্য আকর্ষণ আর বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের নানা কৌশলে। ইইউ’র সাথে এফটিএ হলে তারা আমাদের থেকে এগিয়ে যাবে। এখন আমাদের শুল্ক বাধা দূর করতে হবে, চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। আমাদের ট্যাক্সের পরিমাণ বেশি, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের কথা বলা হলেও এর বাস্তবায়ন কি আছে? লকডাউনে শিপমেন্ট হয়নি, ভিয়েতনাম পেরেছে, কোভিড মোকাবিলায়ও সক্ষম হয়েছে তারা। বিনিয়োগকারীদের আনতে পারলে বিশ্ব বাজারে পোশাক রপ্তানির শীর্ষ দেশ হতে পারবে বাংলাদেশ।