প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছয় দফা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের উন্নয়ন হতো বাংলাদেশের টাকায়। বাংলাদেশে পাট, চা বৈদেশিক মুদ্রা আনলেও আমাদের দেশে কোনো উন্নয়ন হতো না। তিনি বলেন, বঞ্চনার শিকার হতে হতে এবং বৈষম্যে দেখতে দেখতে মানুষ পাকিস্তানের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। যে কারণে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা লুফে নিয়েছিলেন। এই ছয় দফা থেকেই মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা।
বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গণভবন থেকে ভার্চয়ালি সংযুক্ত হয়ে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃক আয়োজিত ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে থিম সংগীত পরিবেশন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ আমাদের দেশে অনেক সচিব আছে। পাকিস্তান সরকারের আমলে বাঙালিদের অসামরিক ক্ষেত্রে সচিব পদে কোনো প্রমোশন হতো না। যুগ্মসচিব পদে একজন না দুজন ছিল। বাঙালি সম্পর্কে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব ছিল। ভারত ভাগ হওয়ার পর যে টাকাটা বাংলাদেশ পাওয়ার কথা সেটাও চলে গেল পাকিস্তানে।’
পাকিস্তান আমলে সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সামরিক ক্ষেত্রে অবস্থা ছিল আরও করুণ। পাকিস্তানে ছিল তিনজন জেনারেল, বাঙালি শূন্য; মেজর জেনারেল ছিল ২০ জন, বাঙালি শূন্য; ব্রিগেডিয়ার ৩৪ জন, বাঙালি শূন্য। মাত্র একজন ছিল কর্নেল পদে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাত্র দুইজন। মেজর ছিল বাঙালি ১০ জন, নৌবাহিনীর অফিসার ও বাঙালি ছিল মাত্র সাতজন। বিমান বাহিনীর অফিসার ছিল ৪০ জন, পশ্চিমাদের ছিল ৬৪০ জন। ঠিক এইভাবে বৈষম্যগুলো ছিল অথচ মেধার দিক থেকে, জ্ঞানের দিক থেকে ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিরা তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। এরপরও তারা আমাদের কোনো সুযোগ দিত না। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতির পিতা ছয় দফা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করা যেত না। যা করবে তা পাকিস্তান হয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ বাঙালির কোনো অধিকারই ছিল না। বৈদেশিক বাণিজ্য করতে পারত না। ছয় দফা দাবিতে নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার বাংলাদেশ স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। সামরিক একাডেমির তৈরি করার দাবি ছিল। প্রত্যেকটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পূর্ব বাংলায় করতে হবে, প্রাদেশিক সরকার কর আদায় করে তার একটি অংশ কেন্দ্রকে দেবে এবং বাকি অর্থ নিজেরা খরচ করবে। এ সবকিছু মিলেই ছিল ছয় দফা দাবি।’
ছয় দফা নিয়ে সমালোচনাকারীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে সব সময় কিছু দালাল শ্রেণি পাওয়া যায়। তারা আবার ছয় দফার পরিবর্তে আট দফার কথা বলেন। আমাদের দলেরই বড় বড় নেতারা ছয় দফা থেকে দূরে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ছয় দফা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। সেখানে শেষ পর্যন্ত ছয় দফাই টিকে যায়। এভাবে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছিল। এরপর পাকিস্তান যখন দেখল যে, না, কোনোকিছুই হচ্ছে না, তখন জাতির পিতার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে ফাঁসি দেয়ার জন্য চেষ্টা করা হলো। এ সময় সারাদেশে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো।’
‘সারা বাংলাদেশের মানুষ এই ছয় দফা দাবি লুফে নিয়েছিল। কোনো দাবি এত অল্প সময়ের মধ্যে এত জনপ্রিয়তা পাবে এবং গ্রহণ করতে পারে, অকাতরে বুকের রক্ত দিতে পারে-এটা কেউ ভাবতেই পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশে এটা সম্ভব হয়েছিল।’
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলেও আন্দোলনের কখন কী করতে হবে সে নির্দেশনা কারাগারে থেকেই দিতেন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘মা যখন দেখা করতে যেতেন তখন তার কাছে এসব বিস্তারিত বলতেন। আমার মা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পার্টির কাছে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তাদের লক্ষ্য ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রায় দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়া। কিন্তু বাংলাদেশে তখন এমন আন্দোলন এবং গণজাগরণ সৃষ্টি হলো যে আন্দোলনের মুখে ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে মুক্তি দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর এভাবে মুক্তি দেয়ার যে ব্যাপারটা খুব অদ্ভূত ছিল সেটা হলো এগারোটা বারোটার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারির একটা গাড়িতে করে এনে ৩২ নম্বরে নামিয়ে দিয়ে সোজা দ্রুত তারা পালিয়ে যায়। মানুষের বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে দেখি, আমাদের বাড়ির পাশের লোকে লোকারণ্য। সেই স্মৃতিটা এখনো আমার মনে পড়ে। এভাবেই ছয় দফা আন্দোলন এক দফায় পরিণত হয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন আলোচনা করতেন, তখন আমাদের পতাকা কী হবে, আমাদের জাতীয় সংগীত কী হবে, আমাদের জাতীয় স্লোগান কী হবে-এটা মনি ভাইয়ের মাধ্যমে আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। মানুষ এটা কীভাবে গ্রহণ করে, মানুষের কাছে এটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য-এসব জানার জন্য। একটা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত করার এক একটা ধাপ পার হয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি। ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় অর্জন হয়েছে।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অনুষ্ঠানে ছয় দফার ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ পাশা ও পঞ্চম স্থান অধিকারী খুলনার রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষিকা খুকু রানী ঘোষ তাদের অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।