লড়াইয়ের ময়দান আলাদা, তবে প্রতিপক্ষ সব চেনা। যাদের সঙ্গে আগের নানা লড়াইয়ে সাফল্যের স্বাদ আছে। কৌশল তাই যেমন জানা, আত্মবিশ্বাসও টইটম্বুর। সেই অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসকে সঙ্গী করেই সফল রাইলি রুশো। বিপিএল খেলে বাংলাদেশের বোলিংয়ের ধারাপাত তার এতটাই ভালো জানা যে, সিডনির ২২ গজেও অনায়াসে ঝড় তুলে উপহার দিলেন দুর্দান্ত সেঞ্চুরি।
বিপিএলে স্রেফ তিনটি মৌসুম খেলেছেন রুশো। প্রথমবার খুব ভালো না করলেও পরের দুবারই তিনি ছিলেন আসরের সর্বোচ্চ রান স্কোরার। প্রতিযোগিতাটিতে বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে দ্বিতীয় সফলতম ব্যাটসম্যান তিনি। মিরপুর, চট্টগ্রাম আর সিলেটে এই তাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, সাকিব আল হাসানদের খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। বিশ্বমঞ্চে সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগালেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
প্রথম ওভারে টেম্বা বাভুমাকে হারানোর পর উইকেটে যান তিনি। এরপর কুইন্টন ডি ককের সঙ্গে মিলে দ্রুতই পাল্টা আক্রমণে হতচকিত করে দেন বাংলাদেশকে। দুজন ছুটতে থাকেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। তাদের থামানোর কোনো পথই যেন জানা ছিল বাংলাদেশের কোনো বোলারের।
ডি কক তবু আউট হন ৩৮ বলে ৬৩ করে। কিন্তু রুশো থামেননি সেঞ্চুরির আগে। ৫৬ বলে ১০৯ রানের ইনিংস খেলে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে এনে দেন দুইশ ছাড়ানো পুঁজি।
সেঞ্চুরি আছে তার বিপিএলেও। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে রংপুর রাইডার্সের হয়ে ৫১ বলে অপরাজিত ১০০ করেন চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে। সেই আসরে ১ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটিতে ৫৫৮ নান করেন তিনি ১৫০ স্ট্রাইক রেট ও ৬৯.৭৫ গড়ে। পরের আসরে খুলনা টাইগার্সের হয়ে ৪৫ গড় আর ১৫৫.৭১ স্ট্রাইক রেটে তার রান ছিল ৪৯৫।
এরপর আর বিপিএলে খেলা হয়নি তার। তবে বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ে ধারণা যে এখনও অটুট, সেটির প্রমাণ সিডনিতে দিলেন দারুণভাবেই। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনেও তিনি খোলামেলাভাবেই বললেন তা।
“ওটা (বিপিএল অভিজ্ঞতা) অবশ্যই সহায়তা করেছে। যদি ভুল না করে থাকি, তিন বছর ওখানে খেলেছি আমি এবং দুবার ছিলাম সর্বোচ্চ রান স্কোরার। এই ছেলেদের অনেকের সঙ্গেই যেমন ওখানে খেলেছি, তেমনি বিপক্ষেও খেলেছি। কাজেই আজকে সামনে কী অপেক্ষায়, তা নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ছিলাম না। আমি তাই বলব, হ্যাঁ, অবশ্যই ওই অভিজ্ঞতা আমাকে সহায়তা করেছে।”
অভিজ্ঞতা যেমন তার বিপিএলে হয়েছে, তেমনি হয়েছে পিএসএল, বিগ ব্যাশ, আইপিএলেও। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার হয়েই তার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দারুণ কাঙ্ক্ষিত ক্রিকেটার হলেও এই ৩৩ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেছেন স্রেফ ২৩ ম্যাচ। টানা সাড়ে ৬ বছর যে দেশের ক্রিকেটে তাকে দেখাই যায়নি!
হ্যাম্পশায়ারের হয়ে কলপ্যাক চুক্তিতে নাম লিখিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংলিশ ক্রিকেটে। জন্মভূমির হয়ে কখনও আর খেলতে পারবেন, সেই বিশ্বাসই ছিল না। বিশ্বকাপ খেলা তো বহুদূর, দেশের জার্সি আবার গায়ে চাপানোর স্বপ্নেও ছিল সংশয়। ম্যাচ সেরা হয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি অকপটে বললেন, বছরখানেক আগেও এমন কিছু ছিল না তার কল্পনার সীমানায়।
“একদমই ভাবতে পারিনি (এক বছর আগে)…তবে কখনও কখনও সবকিছু স্রেফ পক্ষে চলে আসে। এই বছরটা আমার জন্য অবিশ্বাস্য এক রোলার-কোস্টার ভ্রমণ। খুবই খুশি আমি… আজকে এখানে আসতে পেরে গর্বিত। লাখো বছরেও এমন কিছু হবে, ভাবতে পারিনি।”
ভাবনার সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন বলেই হয়তো আবেগের উথাল-পাথাল ঢেউ প্রকাশ পাচ্ছে তার নানা অর্জনে। ফেরার পর ৭টি টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেললেন। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৫ বলে অপরাজিত ৯৬, ভারতের বিপক্ষে ৪৮ বলে ১০০ রানের ইনিংস আছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর তার আবেগময় উদযাপনের স্বাক্ষী হলো সিডনির গ্যালারি আর সবুজ ঘাস।
মাঠের সেই আবেগের উৎসটুকু মাঠের বাইরেও লুকাতে চাইলেন না রুশো।
“আমি খুবই প্যাশনেট একজন মানুষ। এই মাইফলক ছুঁতে পারা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। দেশে আমার পরিবারের জন্যও এটা অনেক বড় কিছু। আনন্দময় এক রোলার কোস্টার ভ্রমণ এটি। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে আবার খেলতে পারাটাই অসাধারণ কিছু।”
তিনি যেমন দেশের হয়ে খেলতে পেরে কৃতজ্ঞ, দলের জন্যও যে তাকে পাওয়া অনেক বড় কিছু, তা তো পারফরম্যান্সেই পরিষ্কার।