স্বপ্ন যখন দেখব, বড় কেন নয়? দেশ ছাড়ার আগে বলে গেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। কি সেই স্বপ্ন? অনুমান করে নিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। চূড়া ছোঁয়ার দুঃসাহস নিয়ে এবার বিশ্বকাপে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
কাজটা কঠিন। ভীষণ কঠিন। আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। পেরুতে হবে অনেক বন্ধুর পথ। তবু বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। স্বপ্নের আগে অবশ্য আছে লক্ষ্য। অন্তত সেরা চারে থাকা। সহজ নয় সেটিও। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবার টুর্নামেন্টের ফরম্যাট।
অনেককে চমকে দিয়েই ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। আরও বিস্ময় উপহার দিয়ে সেমি-ফাইনালে খেলেছে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। তবে ওই দুবারই ফরম্যাট ছিল চমক দেওয়ার জন্য তুলনামূলক সহজ। গ্রুপ পর্বে একটি-দুটি জয়, অন্য ম্যাচের ফল পক্ষে আসা মিলিয়ে ধরা দিয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। কিন্তু বিশ্বকাপে এবার ১০ দল খেলবে পরস্পরের সঙ্গে। ভিন্ন ভিন্ন উইকেটে ভিন্ন শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতিপক্ষকে সামলানো, দীর্ঘ সময় ধরে একাগ্রতা ধরে রাখা, নানা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, প্রতিটি ধাপেই অপেক্ষায় কঠিন চ্যালেঞ্জ।
দলের বড় শক্তি একই সঙ্গে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতা। গড় বয়সের হিসেবে এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম তরুণ দল বাংলাদেশ। আবার ম্যাচ খেলার বিবেচনায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ দলগুলির একটি। একই দলে দুটির সমন্বয় যথেষ্টই বিরল।
বাংলাদেশ দলে এটি সম্ভব হয়েছে, কারণ দলের মূল ক্রিকেটাররা সেই ১৮-১৯ বছর বয়স থেকে একসঙ্গে খেলছেন। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে দলকে পরের স্তরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। চেষ্টা করছেন আরও ওপরে তুলতে। দলের চার ক্রিকেটারের এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ, আরও দুইজনের তৃতীয় বিশ্বকাপ।
মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলার ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের পর থেকে ধরা দিয়েছে আরও অভাবনীয় সব সাফল্য। প্রথম অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন একাধিক বিশ্বকাপে। নেতৃত্বের মতো তার বোলিংও দলের জন্য দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। এখনও তিনি দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক বোলার। নিজের শেষ বিশ্বকাপ রাঙাতে নিশ্চয়ই কমতি রাখবেন না।
তাড়না থাকবে অন্যদেরও। সাকিব আল হাসানের বিশ্বকাপ রেকর্ড খুব খারাপ নয়, তবে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সে নিজের ছাপ সেভাবে রাখতে পারেননি এখনও। ওজন কমিয়ে, নিবিড়ভাবে অনুশীলন করে এই অলরাউন্ডার বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বকাপে করতে চান বড় কিছু।
তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহকে নিয়েও বলা যায় একই কথা। গত বিশ্বকাপের পর থেকে ওয়ানডেতে বিশ্ব ক্রিকেটেরই সবচেয়ে সফল ও ধারাবাহিক ব্যাটসম্যানদের একজন তামিম। নিজের ব্যাটসম্যানশিপকে এই সময়টায় নিয়ে গেছেন তিনি নতুন উচ্চতায়।
গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের তিনটি জয়ে অসাধারণ ইনিংস খেলেছিলেন মুশফিক। সেই ধারা ধরে রেখেছেন পরেও। দলের প্রয়োজনের সময় বরাবরই চওড়া তার ব্যাট। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসগুলোর বেশ কটিই এসেছে তার ব্যাট থেকে।
মাহমুদউল্লাহ গত বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়েছিলেন দুটি সেঞ্চুরি করে। বিশ্বকাপের পর অবশ্য চার নম্বরে জায়গা ধরে রাখতে পারেননি। তবে পরে নতুন ভূমিকায়ও মানিয়ে নিয়েছেন দারুণভাবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সময়ের সেরা ফিনিশারদের একজন তিনি।
বাংলাদেশের পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারই বড় আসরে বড় কিছুর প্রস্তুতি নিয়েছেন দারুণভাবে। তারাই বিশ্বকাপে দলের স্বপ্নসারথী।
সিনিয়রদের সঙ্গে মুস্তাফিজুর রহমান ও সৌম্য সরকার নিজের দিনে গড়ে দিতে পারেন পার্থক্য। মেহেদী হাসান মিরাজের ওপর নির্ভর করা যায় নিশ্চিন্তে। কোনো এক স্পেলেই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন রুবেল হোসেন। সাইফ উদ্দিন উন্নতির প্রমাণ দিচ্ছেন প্রতিনিয়মত। সঙ্গে অন্যরাও যদি নিজেদের কাজ ঠিকঠাক করতে পারেন, লক্ষ্য পূরণ বা স্বপ্ন ছোঁয়া, অসম্ভব নয় বাংলাদেশের জন্য।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পথচলার ধারা অবশ্য এবার আশা দেখাতে ভয় জাগায়। একবার ভালো, পরের বার খারাপ, এই ধারাবাহিকতা ছিল আগের পাঁচটি বিশ্বকাপে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়ের পর পাকিস্তানকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০০৩ বিশ্বকাপ ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে সুপার এইটে ওঠা, সেখানে সেই সময়ের র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর স্বাদ পেয়েছিল দল। ২০১১ বিশ্বকাপে দেশের মাটিতে মেলেনি প্রত্যাশিত সাফল্য। এরপর ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের ইতিহাস। এবার?
গত কয়েক বছরে এই দল অনেক পূর্ব ধারণাই বদলে দিয়েছে। দেশের ক্রিকেটে এনে দিয়েছে দারুণ সব সাফল্য। বিশ্বকাপের মতো আসরে হতে পারে অনেক কিছুই। স্বপ্ন অনেক সময় ধরা দেয় সত্যি হয়ে, কখনও আবার গুঁড়িয়ে যায় নিমর্মভাবে। তবে দলটির সামর্থ্য, সাম্প্রতিক বছর গুলোয় অগ্রগতি সাহস দেখায় আকাশ ছুঁতে।
গুরুত্বপূর্ণ যিনি: মুস্তাফিজুর রহমান
গত বিশ্বকাপের পরপর দেশের ক্রিকেটকে উদ্ভাসিত করে, ক্রিকেট বিশ্বকে বিস্ময় উপহার দিয়ে আবির্ভাব এই বাঁহাতি পেসারের। রেকর্ড গড়া সাফল্যে রাঙিয়েছেন শুরুর সময়টা, চোট-অস্ত্রোপচারের বাস্তবতার ধাক্কাও সয়েছেন। পিছু না ছাড়া চোটের ধাক্কায় শুরুর বিধ্বংসী চেহারাটা এখন দেখা যায় না প্রায়ই, তবে এখনও যথেষ্ট কার্যকর ও দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতায় বড় ভূমিকা থাকবে মুস্তাফিজের পারফরম্যান্সের।
কোচ: স্টিভ রোডস
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে। খুব প্রভাববিস্তারী নন তিনি, পছন্দ করেন না তত হাঁকডাক। নিজের মতো করে কাজ করে যান। টেকনিক্যাল দিক থেকে বা গেম রিডিংয়ের ব্যাপারগুলিতে তার দক্ষতা এখনও প্রমাণের দাবি রাখে। তবে ক্রিকেটারদের সঙ্গে মেশা, দলকে অনুপ্রাণিত করা, একাট্টা করার কাজগুলি করে যাচ্ছেন দারুণভাবে। চুক্তি যদিও আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত, তবে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপের ভাবনা মাথায় রেখেই মূলত ইংলিশ কোচ হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছিল বিসিবি। বিশ্বকাপ তাই তার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ দল:
মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক), লিটন দাস, মাহমুদউল্লাহ, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ মিঠুন, মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন, মুশফিকুর রহিম, মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকার, তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান (সহ-অধিনায়ক), মোসাদ্দেক হোসেন, আবু জায়েদ চৌধুরী।
বিশ্বকাপের রেকর্ড:
১৯৯৯: গ্রুপ পর্ব
২০০৩: গ্রুপ পর্ব
২০০৭: সুপার এইট
২০১১: গ্রুপ পর্ব
২০১৫: কোয়ার্টার-ফাইনাল
বিশ্বকাপ সূচি:
তারিখ, বার | বাংলাদেশ সময় | প্রতিপক্ষ | ভেন্যু |
০২ জুন, রোববার | বেলা সাড়ে তিনটা | দক্ষিণ আফ্রিকা | দা ওভাল, লন্ডন |
০৫ জুন, বুধবার | সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা | নিউ জিল্যান্ড | দা ওভাল, লন্ডন |
০৮ জুন, শনিবার | বেলা সাড়ে তিনটা | ইংল্যান্ড | সোফিয়া গার্ডেনস, কার্ডিফ |
১১ জুন, মঙ্গলবার | বেলা সাড়ে তিনটা | শ্রীলঙ্কা | কাউন্টি গ্রাউন্ড, ব্রিস্টল |
১৭ জুন, সোমবার | বেলা সাড়ে তিনটা | ওয়েস্ট ইন্ডিজ | কাউন্টি গ্রাউন্ড, টন্টন |
২০ জুন, বৃহস্পতিবার | বেলা সাড়ে তিনটা | অস্ট্রেলিয়া | ট্রেন্ট ব্রিজ, নটিংহ্যাম |
২৪ জুন, সোমবার | বেলা সাড়ে তিনটা | আফগানিস্তান | দা রোজ বোল, সাউথ্যাম্পটন |
০২ জুলাই, মঙ্গলবার | বেলা সাড়ে তিনটা | ভারত | এজবাস্টন, বার্মিংহাম |
০৫ জুলাই, শুক্রবার | সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা | পাকিস্তান | লর্ডস, লন্ডন |