বাংলাদেশ ঋণ চেয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার, অনুমোদন ৪৭০ কোটি ডলার

image-640522-1675195518

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বাংলাদেশের জন্য আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতিকাঠামো আধুনিকায়ন ও জলবায়ুর টেকসই উন্নয়ন জরুরি।

এসব খাত জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার না হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এজন্য তারা সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুরে আইএমএফ-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশবিষয়ক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়। মঙ্গলবার মধ্যরাতে আইএফএফ-এর নির্বাহী বোর্ড বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন দেয়। বিষয়টি মঙ্গলবার আইএমএফ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে তিনটি ঋণ কর্মসূচির আওতায় ৪৫০ কোটি ডলার চেয়েছিল। সংস্থাটি বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে, যা বাংলাদেশের চাওয়ার চেয়ে ২০ কোটি ডলার বেশি। ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এ মাসের প্রথমদিকেই ছাড় করা হবে। পরবর্তী অংশ প্রতি ছয় মাস পর মোট ছয়টি কিস্তিতে ছাড় হবে। শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।

আইএমএফ-এর এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) বা বর্ধিত ঋণ সুবিধা এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) বা বর্ধিত তহবিল সুবিধার আওতায় পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে। ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে গড়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়, আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমবে। বাড়বে রেমিট্যান্স, বেসরকারি খাতে ঋণ ও মূল্যস্ফীতির হার। আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি আয়, আমদানি ব্যয় ও রিজার্ভ বাড়বে। কমবে রেমিট্যান্স ও মূল্যস্ফীতির হার। অর্থাৎ আগামী বছরেও মন্দার কিছু প্রভাব থাকবে।

আইএমএফ বলেছে, করোনার পর অর্থনৈতিক মন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটিয়ে উঠতে এই ঋণ বাংলাদেশকে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সংস্কার এগিয়ে নিলে এই ঋণ দেশটিকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তা করবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে মানব উন্নয়ন, অবকাঠামো খাত ও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশও এই চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করেছে। দ্রুত এসব খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে বা সংস্কার না করলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।

আইএমএফ বলেছে, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। এসব বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

নির্বাহী বোর্ডে আইএমএফ-এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত এম সায়েহ এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। করোনা মহামারি এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। একাধিক ধাক্কা বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।

তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশকে দেওয়া এই ঋণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করবে এবং সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। সরকারকে কর নীতি এবং রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার করতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ঋণের ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য আর্থিক সংস্কার ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তিনি আরও বলেছেন, আর্থিক খাতের দুর্বলতা হ্রাস করা, তদারকি জোরদার, শাসনব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো উন্নত করে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে এই ঋণ সরকারকে সহায়তা করবে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতির একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। গত মাসের বিশ্বব্যাংক বলেছে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।

আইএমএফ-এর মতে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে। আগামী অর্থবছর থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। ওই অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ হার আরও বেড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এটি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। চলতি অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে ভোগ হ্রাস পাবে। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ কমতে পারে। আমদানি ব্যয় কমতে পারে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে আগামী অর্থবছর থেকে রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয় দুটোই বাড়বে।

চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। আগামী অর্থবছর থেকে এ হার কমতে শুরু করবে। তবে চলতি অর্থবছর শেষে এ হার ৮ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে।

বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে কিছুটা কমবে। তবে আগামী অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে যাবে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি কমলেও আগামী অর্থবছরে বেড়ে যাবে। এর পর থেকে কমবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ চলতি অর্থবছরে বাড়বে। তবে আগামী অর্থবছরে কমবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি অর্থবছরে আরও কমে ৩ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত নামতে পারে। আগামী অর্থবছর থেকে রিজার্ভ আবার বাড়তে শুরু করবে। আগামী অর্থবছরে তা সামান্য বেড়ে ৩ হাজার ৪২০ কোটি ডলার হতে পারে। এর পরের বছর ৪ হাজার কোটি ডলার হতে পারে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে রিজার্ভ ৫ হাজার ৩১০ কোটি ডলার হতে পারে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ চলতি অর্থবছরে সামান্য বাড়বে। তবে আগামী অর্থবছর থেকে বেশি হারে বাড়বে।

Pin It