‘তিনবেলা পেট ভরে খেতে হলে রাষ্ট্রীয় অর্থ সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদন করুন’- লিফলেটে এমন আহ্বান জানিয়ে গ্রাম-গঞ্জের সহজ সরল মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে ‘গোলাঘর’ নামের একটি সংগঠন। একটি প্রতারক চক্র এ সংগঠনের পরিচয়ে মাত্র ২ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ৫শ’ টাকায় আবেদন ফরম বিক্রি করছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে তারা অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
জানা গেছে, মাগুরা, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এ চক্র। মাত্র দুই শতাংশ সুদ এবং বাড়তি কোনো চার্জ নেই- এমন প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই এ ফরম কিনছেন। মাগুরা জেলার বেরইল পলিতা বাজারের অন্তত ১১৭ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এ ফরম কিনেছেন বলে জানা গেছে। একই জেলার শালিখা ও বুনাগাতি, সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ, পাইকশা ও কোনাবাড়ী, ঠাকুরগাঁও সদর এলাকার ফেরসাডাঙ্গি, পূর্ব গিলাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় শত-শত মানুষের কাছে ফরম বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে গোলাঘর পরিচালনায় কারা আছেন অর্থাৎ প্রতারক চক্রের হোতাদের পরিচয় জানা যায়নি।
গোলাঘর কমিটির নামে দুই পৃষ্ঠার একটি লিফলেট ছাপিয়েছে এ চক্র। সেখানে এর সদস্য হওয়ার একটি নিয়ম উল্লেখ করে তাদের মাধ্যমে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদন করতে বলা হয়েছে। লিফলেটের তৃতীয় লাইনে ঋণ পাইয়ে দেওয়াসহ গোলাঘরের কার্যক্রমের সূত্র হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৮ সালের ২৪ জুলাইর একটি চিঠির রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। যার সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক পত্র নং বিআরপিডি/নীতি-৪/৭৭০/২০১৮-৫২৭৫।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সূত্রে উল্লিখিত একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঠাকুরগাঁও জেলার পূর্ব গিলাবাড়ী গোলাঘর কমিটির সেল লিডার সাদ্দাম হোসেনের আবেদনের জবাব হিসেবে ইস্যু করা হয়েছিল। কোনোভাবেই তো কাউকে ঋণ দেওয়া বা অন্য কোনো বিষয়ে নয়। কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম উল্লেখ করে ঋণের আবেদন ফরম বিক্রি করে থাকলে, তা অবশ্যই প্রতারণা।
জানা গেছে, সাদ্দাম হোসেনের আবেদন ছিল গোলাঘরের সদস্যদের নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক পত্রের উত্তরে জানায়, যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে আবেদন করে নিজেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। ফলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। এখান থেকে শুধু নীতি সহায়তা দেওয়া হয়। একই বিষয়ে এর আগে আবেদন করেন এমন কয়েকজনের অবগতির জন্য চিঠির অনুলিপি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তালিকায় রয়েছেন সিরাজগঞ্জের কোনাবাড়ী এলাকার সেল লিডার শফিকুল ইসলাম সরকার পান্না, ডলি বেগম, মো. বাবুল মিঞা, সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের আব্দুল মমিন খান এবং ঠাকুরগাঁওয়ের নরেশ মোহন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠির সূত্র ধরে সাদ্দাম হোসেনের কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, তিনি কোনো চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকে লেখেননি। তবে শহর থেকে আসা একজনের কথা মতো কম সুদে ঋণ পাওয়ার জন্য পাঁচশ’ টাকা দিয়ে গোলাঘর কমিটির সদস্য হয়ে ঋণ পাওয়ার আশায় আছেন। তার দেখাদেখি ওই এলাকার অনেকেই পাঁচশ’ টাকায় ফরম কিনে এখন গোলাঘরের লোকজনের হদিস পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যাদের নামে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছিল তাদের একজন মো. শফিকুল ইসলাম সরকার পান্না। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, হাফিজ নামের একজনের কথা মতো তিনি ফরম পূরণ করেছেন। আর তাদের নামে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি চিঠি এসেছে বলে শুনেছেন।
মাগুরা জেলার বেরইল পলিতা বাজারে দোকানে-দোকানে গিয়ে কম সুদে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন মো. ইকবাল নামের এক ব্যক্তি। তার কথা মতো এক বছরে মাত্র দুই হাজার টাকা সুদে এক লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার জন্য ওই বাজারের অন্তত ২১৭ জন ফরম কিনেছেন। এভাবে অর্থ নেওয়া যে প্রতারণা, তা প্রথম সন্দেহ করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য কাজী হোসেন। বিষয়টি জানার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মরত তার এক বন্ধুকে ফোন করে বুঝতে পারেন, এটা স্রেফ প্রতারণা।
জানতে চাইলে কাজী হোসেন সমকালকে বলেন, বিষয়টি শোনার পর তার সন্দেহ হয়। তখন খোঁজাখুঁজি করে ফরম বিক্রেতা ইকবালকে বের করেন। ইকবাল তাকে জানায়, মাগুরা বাজারের একজনের এজেন্ট হয়ে সে ফরম বিক্রি করছে। দুই সপ্তাহে ওই বাজারের দুই শতাধিক ফরম বিক্রি করেছে। চাপাচাপির এক পর্যায়ে ইকবাল মাগুরা গিয়ে তার ‘বস’ এর সঙ্গে কথা বলে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে ইকবালকে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর ফোন ধরে বলে, তার মা অসুস্থ। শেষ পর্যন্ত আর টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে পারেননি কাজী হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম ভাঙিয়ে ঋণ দেওয়ার লোভ দেখানো গুরুতর অপরাধ। এমন কেউ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হবে।
ফরম কিনে সদস্য হয়েছেন এরকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা জানান, তাদের বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু এ ঋণের ব্যবস্থা করবে, সেহেতু কোনো সার্ভিস চার্জ দিতে হবে না। সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তি পরিশোধের ঝামেলাও নেই। ঋণের জন্য কোনো জামানতও লাগবে না। শুধু নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, দুই কপি ছবি এবং একজন গ্যারান্টারের স্বাক্ষরে ফরম পূরণ করে জমা দিলে কিছুদিনের মধ্যে ঋণ পাওয়া যাবে।