বাজারভিত্তিক ডলার রেটের শর্ত পূরণ না করায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশেষ করে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও আমদানিকারকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দর বেঁধে দেওয়া অবাস্তব হিসাবে দেখছে সংস্থাটি।
এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক যে দরে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করে সেটিও বাজারভিত্তিক নয় বলে জানিয়েছে আইএমএফ। আর বাজারভিত্তিক ডলার রেট না করায় রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমছে এমন ধারণা দাতা সংস্থাটির। পাশাপাশি বাংলাদেশ ফরেন একচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) যে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে তার বৈধতা আছে কিনাসহ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রশ্নে জর্জরিত করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। কিন্তু কোনো জবাবে সন্তোষ প্রকাশ করেনি আইএমএফ-জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডলার, তারল্য সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমফের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। আইএমএফ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন রাহুল আনন্দ।
অপর একটি সূত্র জানায়, তারল্য সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যা রিজার্ভ কমাতে সরাসরি প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। এসব বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
এদিকে সকালে আইএমএফের সঙ্গে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আবারও ঋণের সুদ হার বাড়াল বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি একদিনের ব্যবধানে ঋণের সুদ হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত। অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি সামাল দিতেই এমন সিদ্ধান্ত। সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট বা স্মার্ট রেট বাড়িয়ে সাড়ে ৩ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশের বদলে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে।
এতে বলা হয়, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এক্ষণে, মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে হ্রাস করার লক্ষ্যে ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশের স্থলে সর্বোচ্চ ৩.৫ শাতংশ মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশের স্থলে সর্বোচ্চ ২.৫ শাতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। তবে কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মার্জিন ২ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে।
মাত্র একদিন আগেই (বুধবার) নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন নীতি সুদহার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে নতুন নীতি সুদহার বা রেপো রেট হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদহারও বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন। দেশে সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। এই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমেছে, যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১২ শতাংশের উপরেই ছিল। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে ওঠে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে সেপ্টেম্বরের মূল্যস্ফীতির এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, সেপ্টেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে, যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর শহরে সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
সিপিটিইউর কাজে সন্তুষ্ট আইএমএফ : সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) কাজে আইএমএফ সন্তোষ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সিপিটিইউর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আইএমএফের ক্লাইমেট পলিসি ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ইকোনমিস্ট সুফাচল সুফাচালাসাই সিপিটিইউতে আসেন।
বৈঠকে তিনি জানতে চান টেকসই সরকারি ক্রয় নীতিমালা তৈরি এখন কোন অবস্থায় আছে। এছাড়া এই নীতিমালা তৈরিতে স্টেকহোল্ডারদের (সুবিধাভোগী) মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছ কিনা। এ সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিষয় জানতে চান। এর জবাবে সিপিটিইউর পক্ষ থেকে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে জানানো হয়েছে যে, এই নীতিমালা তৈরিতে সব পক্ষের মতামত নেওয়া হয়েছে।
ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে মতামত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে কর্মশালার আয়োজনও করা হয়। অর্থাৎ একটি নীতিমালা অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে যেসব প্রক্রিয়া পার করতে হয় তার সবই করা হয়েছে। বর্তমানে নীতিমালাটির প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ৯ অক্টোবর সাসটেইনেবল পাবলিক প্রকিউরমেন্ট পলিসিটি মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি বোধ হয় সম্ভব হচ্ছে না। এর পরের সপ্তাহে হতে পারে। আইএমএফ প্রতিনিধি সিপিটিইউর কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। কেননা যেসব প্রক্রিয়া মেনে নীতিমালাটি করা দরকার সবই আমরা করেছি। এছাড়া দ্রুততার সঙ্গে এটি করায় আইএমএফ খুশি হয়েছে।