বাজেটের সুবিধা নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে হলে প্রথমে লুটপাট বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে ভঙ্গুর ব্যাংক খাত। কমিয়ে আনতে হবে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে খেয়ে ফেলছে । সার্বিক বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট সমাধান থাকা দরকার। একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ।
কেমন বাজেট দেখতে চান?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : প্রতি বছর বাজেট আসে, বাজেট যায় কিন্তু তাতে নাগরিকের কী লাভ! বিশেষ মহল সুবিধা ভোগ করে। সেজন্য বলব এবারের বাজেটে মোটা দাগে কয়েকটি চাওয়ার মধ্যে একটি হলো নাগরিককে তিন বেলা পেটভরে খাওয়ার সুবিধা দিতে হবে। এরপর বাসস্থান, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সুবিধা সব নাগরিক সমানভাবে পাওয়ার অধিকার রাখে। এ ক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি চলবে না। এসব মৌলিক অধিকারের বরাদ্দে কোনো লুটপাট করা যাবে না। এছাড়া বাজেটের উচ্চ ব্যয় মেটাতে আয় বাড়াতে হবে। বিশেষ করে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ কমাতে করণীয় কী?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আবার কমেছেও। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু বেড়েছে, কমার লক্ষণ নেই। প্রায় সব দেশের মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কমছে না। কারণ এখানে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এখানে ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। যে ধনী সে আরও ধনী হচ্ছে। আর যে গরিব সে আরও গরিব হচ্ছে। সেজন্য আয়বৈষম্য যেন সন্তোষজনক পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়-বাজেটে তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ভঙ্গুর ব্যাংক খাত দিয়ে কীভাবে বাজেট বাস্তবায়ন হবে?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : বাজেট বাস্তবায়নে লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে চলাচল করবে। কিন্তু ভঙ্গুর ব্যাংক খাত দিয়ে তা কী করে সম্ভব, এটি একটি বড় প্রশ্ন। আসলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা দেখালেও প্রকৃত খেলাপি আরও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই। বড় অঙ্কের এ ঋণ ঢেকে রেখে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি উন্নয়ন সম্ভব নয়। এছাড়া দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে অনেকে আমানত তুলে নিয়েছেন। এর আগে পিপলস লিজিং অবসায়ন করে আমানতকারীদের বিপদে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে লুটপাটে জড়িত কারও বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। লুটপাটের শিকার ফারমার্স থেকে পদ্মা ব্যাংকে রূপ নেওয়া এ ব্যাংকটিকে বাঁচাতে প্রায় হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। সে টাকা গেল কোথায়? তার কোনো হিসাব নেই। ব্যাংক তো বাঁচল না। এখন একীভূত করা হচ্ছে। মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে ব্যাংক খাতে লুটপাট শুরু হয়। যা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকে। প্রথমে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এরপর বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি, বেসিক ব্যাংকে লুটপাট ও ফারমার্স ব্যাংকে ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতিসহ অন্যান্য আরও অনেক জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের তৎকালীন পর্ষদ সরাসরি জড়িত ছিল। তাই কোনো অবস্থায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ঋণ বিতরণের সঙ্গে রাখা উচিত নয়। পর্ষদ পলিসি দেবে। আর তা কার্যকর করবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। সেজন্য বাজেটে আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার আগে ২২ পরিবার লুটেপুটে খেয়েছে। এখন খাচ্ছে অন্তত ২২০০ পরিবার।
পাচার করা টাকা ফেরতে বাজেটে কেমন প্রতিশ্রুতি চান?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়েছে। এসব টাকা দেশে থাকলে অনেক উন্নতি করা যেত। মূলত দুর্নীতি যত বাড়বে টাকা পাচারও তত বাড়বে। সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশে সব দেশেই কম বেশি টাকা পাচার হয়। তবে এ দেশের মতো এত বেশি টাকা পাচার পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে জানা নেই। টাকা পাচারের কারণে ডলার সংকট শুরু হয়। আর ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ নেমে আসে তলানিতে। সেজন্য আসন্ন বাজেটে পাচার করা টাকা ফেরতে সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : অর্থনীতি চলছে ভুল পদ্ধতিতে। এখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। সেজন্য বাজেটে এসব বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে নিম্নমুখী ধারা, এর কারণ এবং উত্তরণের উপায় কী?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : রেমিট্যান্স কমার প্রধান কারণ হুন্ডি। এটা বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স বাড়বে না। আর রপ্তানির জন্য নতুন নতুন বাজার তৈরি করতে হবে। পণ্যের মানে ভিন্নতা ও নতুনত্ব আনতে হবে।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অগ্রণী ব্যাংক