জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এই বাজেট বাস্তবায়নে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। তারা বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে বরাদ্দ অর্থের যথার্থ ব্যবহার হয় না। এখন থেকেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি মানুষের কল্যাণে বাজেটের কাঠামো নতুন করে সাজানো দরকার। যাতে অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ানো যায়।
শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘বাজেট ২০১৯-২০ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনেরা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এ বৈঠকের আয়োজন করে।
বৈঠকে সুজনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বিশ্বের অন্য দেশে বাজেট নিয়ে সংসদে এত আলোচনা না হলেও সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে। আর দেশে বাজেটের অনেক আলোচনা হলেও প্রান্তিক মানুষের সমস্যার তেমন সমাধান হয় না। বাজেটে কৃষকের সমস্যা দেখা হয়নি। ধানের উৎপাদন মূল্য কম হওয়ার জন্য ভর্তুকি দেওয়ার দরকার ছিল। হলফনামার তথ্যানুযায়ী, অর্থমন্ত্রী দেশের শীর্ষ ধনীদের একজন। তিনি দরিদ্রদের জীবন নিয়ে কতটা ভাববেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব পেলেও বাজেটে স্বচ্ছতার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাজেট এখন ছক বাঁধা বাজেটে পরিণত হয়েছে। কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণে বাজেট নতুন করে সাজানো দরকার। যাদের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন হয়ে থাকে, তাদের জন্য কতটা সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে তা দেখা দরকার। দেশের উন্নয়নের জন্য বাজেটে সাধারণ জনগণের জন্য কিছু থাকবে না– এটা হতে পারে না।
তিনি বলেন, বাজেটে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দরিদ্র মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, জুলাই থেকে জুন মাস অর্থবছরের সময়সীমা হওয়ায় নানান ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বছরের শেষ সময়ে জুনে বর্ষাকালে তড়িঘড়ি করে কাজ হওয়ায় প্রকল্প খরচ বাড়ে। পাকিস্তানসহ দু-তিনটি দেশ ছাড়া কোথাও জুলাই-জুন অর্থবছর নেই। তাই এর পরিবর্তন করা দরকার। এটি জানুয়ারি-ডিসেম্বর কিংবা বাংলা বছর বৈশাখ-চৈত্র হতে পারে।
তিনি বলেন, বাজেটের আকার বৃদ্ধি কোনো চমক নয়। এটা বয়স বাড়ার মতো, প্রতিবছর বাড়তেই থাকবে। বরং বিভিন্ন খাতে বাজেটে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, পরিমাণ ও গুণগত মান ঠিক রেখে তা কতটা বাস্তবায়ন হয় সে বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। বাজেটে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাজেটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, খাতভিত্তিক বরাদ্দ ও সমস্যা নির্ধারণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ অত্যধিক। প্রতিবছরই বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হারেও দেখা যায় নিম্নমুখিতা।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার চর্চা নেই। বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংশোধিত হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী সংশোধিত বাজেট সংসদে উপস্থাপন হলেও প্রায় আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়। কেন সংশোধনের প্রয়োজন হলো বা কেনই-বা বাস্তবায়িত হলো না তা জানা যায় না। বাজেটের পুরো প্রক্রিয়াটিতে জবাবদিহিতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ঘাটতি রয়েছে। বাজেট ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
সাবেক সচিব ও কলামিস্ট আব্দুল লতিফ মণ্ডল সম্পূরক বাজেট নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে আয়বৈষম্য কমছে না, বরং বাড়ছে। সবচেয়ে কম আয়ের ১০ ভাগ মানুষের সম্পদ কমেছে।
তিনি বলেন, জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়েনি। তবুও যা দিয়েছে তা দিয়ে জিপিএ ৫ না বাড়িয়ে, কর্মসংস্থানের উপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্য বাজেট বাস্তবায়নে জোর দেওয়া উচিত।
বৈঠকে সুজনের সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, বাজেটে অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমানো দরকার। বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের খাতভিত্তিক ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট সংসদে উত্থাপন হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বাম নেতা জোনায়েদ সাকি ও সুজনের কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের জীবন, কর্ম ও চিন্তা নিয়ে লেখা ‘একান্ত আলাপচারিতায় ড. বদিউল আলম মজুমদার’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। নেসার আমিনের লেখা এই বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী।