যে টেস্ট ক্যারিয়ার থেমে যেতে পারত ৮০ উইকেটে, সেটিই শেষ পর্যন্ত ছুঁয়েছে ৮০০ উইকেটের উচ্চতা! বোলিং অ্যাকশন নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন ও অনেকের ভ্রুকুটি সঙ্গী করেই এগিয়ে গেছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। অদম্য পথচলায় সব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে পা রেখেছেন একের পর এক রেকর্ডের চূড়ায়। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সর্বকালের সফলতম বোলার হিসেবে। লঙ্কান স্পিন জাদুকরের জন্মদিনে তার রেকর্ডগুলোর দিকে একবার ফিরে তাকানোই যায় !
১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল ক্যান্ডিতে জন্ম মুরালিধরনের। অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে টেস্ট অভিষেক ১৯৯২ সালে। সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে যায় ৩ বছর পরই।
১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্ন টেস্টে মুরালিধরনকে চাকিংয়ের জন্য ‘নো’ বল ডেকেছিলেন আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার। তখন তার উইকেট ছিল কেবল ৮০টি। তার বোলিং অ্যাকশন নিয়ে এরপর কাটাছেঁড়া হয়েছে অনেক। ওয়ানডেতেও ডাকা হয়েছিল ‘নো’ বল। কয়েক দফায় বিশেষভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে অ্যাকশন। বায়োমেকানিকস পরীক্ষাও হয়েছে।
সব পরীক্ষায় উতরে ২২ গজে তিনি রচনা করেছেন একের পর এক মহাকাব্য। গড়েছেন অবিশ্বাস্য সব কীর্তি। পরিসংখ্যানের পাতায় এমন সব আঁকিবুকি তিনি করেছেন, এখনও তা জাগায় বিস্ময়।
তার রূপকথাময় ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য কিছু সংখ্যা তুলে ধরা হলো এখানে:
* আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম বোলার মুরালিধরন। তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৪৯৫ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ১ হাজার ৩৪৭ উইকেট।
হাজার উইকেট ছুঁতে পেরেছেন আর কেবল আরেক স্পিন কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন। এই অস্ট্রেলিয়ান কখনও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেননি। অন্য দুই সংস্করণ মিলিয়ে ৩৩৯ ম্যাচে উইকেটে ১ হাজার ১টি।
* টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার মুরালিধরন।
২০০৪ সালের মে মাসে কোর্টনি ওয়ালশের ৫১৯ উইকেটের রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রথমবার তিনি পা রাখেন চূড়ায়। পরে মুরালিধরনকে ছাড়িয়ে যান শেন ওয়ার্ন। ৭০৮ উইকেটের রেকর্ড নিয়ে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয় ওর্য়ানের ক্যারিয়ার। ওই বছরের ডিসেম্বরে রেকর্ড আবার নিজের করে নেন মুরালিধরন।
টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট নিয়ে ছুঁয়েছেন ৮০০ উইকেট। তার ধারেকাছে নেই কেউ।
* ওয়ানডেতেও সবচেয়ে বেশি উইকেট মুরালিধরনের। ওয়াসিম আকরামের ৫০২ উইকেটের রেকর্ড তিনি পেরিয়ে যান ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০১১ বিশ্বকাপ দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৩৫০ ম্যাচে ৫৩৪ উইকেট নিয়ে।
* টেস্টে ৯টি ভিন্ন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচে ১০ উইকেটের স্বাদ পাওয়া একমাত্র বোলার।
* টেস্টের এক ইনিংস ৯ উইকেট দুইবার শিকার করা মাত্র দুই বোলারের একজন মুরালিধরন। তবে তিনিই একমাত্র আলাদা দুই টেস্টে পেয়েছেন এই স্বাদ। ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওভালে নিয়েছিলেন ৬৫ রানে ৯ উইকেটে, ২০০২ সালে ক্যান্ডিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫১ রানে ৯টি।
ইংলিশ অফ স্পিনার জিম লেকার দুইবার নিয়েছিলেন একই টেস্টে। ১৯৫৬ অ্যাশেজে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ৫১ রানে ১০ উইকেট ও ৩৭ রানে ৯ উইকেট। এখনও টেস্ট ইতিহাসে এক ম্যাচে সেরা বোলিং সেটি।* ওয়ানডেতে এক ইনিংস ৭ উইকেট নেওয়া প্রথম স্পিনার ও এখনও পর্যন্ত একমাত্র অফ স্পিনার তিনি। ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে শারজাহতে নিয়েছিলেন ৩০ রানে ৭ উইকেট।
স্পিনারদের মধ্যে এরপর ৭ উইকেট নিতে পেরেছেন তিন লেগ স্পিনার শহিদ আফ্রিদি (৭/১২), রশিদ খান (৭/১৮) ও ইমরান তাহির (৭/৪৫)।
* ৯টি ভিন্ন দেশের বিপক্ষে টেস্টে ৫০ উইকেট শিকারি একমাত্র বোলার।
* এক মাঠে টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারি বোলার। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ২৪ টেস্টে নিয়েছেন ১৬৬ উইকেট।
এই রেকর্ডের পরের দুটি জায়গাও মুরালিধরনের। ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়ামে (এখন সেটি পরিত্যক্ত) ১৬ টেস্টে নিয়েছেন ১১৭ উইকেট, গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ১৫ টেস্টে ১১১টি।
* অন্তত ৫০টি টেস্ট খেলেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলিং গড়, ২২.৭২।
* টেস্টে সবচেয়ে বেশি বার ৫ উইকেট, ৬৭ বার। অনেকেটা পেছনে থেকে দুইয়ে ওয়ার্ন, ৩৭ বার।
* টেস্টে সবচেয়ে বেশি বার ম্যাচে ১০ উইকেট, ২২ বার। এখানেও দুইয়ে থাকা ওয়ার্ন অনেক পিছিয়ে, ১০ বার।
* ওয়ানডেতে ৫ উইকেটের স্বাদ সবচেয়ে বেশি বার পাওয়া স্পিনার। ১০ বার নিয়েছেন ম্যাচে ৫ উইকেট। পেস-স্পিন মিলিয়ে তার চেয়ে বেশি নিয়েছেন কেবল সাবেক পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার ওয়াকার ইউনিস, ১৩ বার।
* ৫ উইকেটের বাইরে ওয়ানডে ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়েছেন মুরালিধরন ১৫ বার। এই রেকর্ডেও তিনি স্পিনারদের সবার ওপরে। সাবেক পাকিস্তানি পেসার ওয়াসিম আকরাম নিয়েছেন ১৭ বার।
* টানা চার টেস্টে ম্যাচে ১০ উইকেটের অবিস্মরণীয় রেকর্ড তার। অবিশ্বাস্যভাবে, সেটি তিনি করেছেন দুই দফায়! ২০০১ ও ২০০৬ সালে।
* টেস্ট ও ওয়ানডে, দুটিতেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ডেলিভারি বেরিয়েছে মুরালিধরনের হাত থেকে। টেস্টে করেছেন ৪৪ হাজার ৩৯ বল, ওয়ানডেতে ১৮ হাজার ৮১১টি।
* টেস্টে সবচেয়ে বেশি ব্যাটসম্যানকে বোল্ড আউট করা বোলার। ১৬৭ উইকেট নিয়েছেন বোল্ড করে। তার বলে ব্যাটসম্যানরা স্টাম্পড হয়েছেন সবচেয়ে বেশি বার, টেস্টে ৫৬ ও ওয়ানডেতে ৪৭ বার।
* টেস্টে দ্রুততম ৩৫০, ৪০০, ৪৫০, ৫০০, ৫৫০, ৬০০, ৬৫০ ও ৭০০ উইকেটের রেকর্ড তার। ওয়ানডেতে দ্রুততম ৪৫০ উইকেট ও ৫০০ উইকেট তার।
* টেস্টে সবচেয়ে বেশিবার ম্যান অব সিরিজ, ১১ বার। সবচেয়ে বেশি বার ম্যান অব দা ম্যাচ হওয়ার রেকর্ডে আছেন দুইয়ে (১৯ বার, জ্যাক ক্যালিস ২৩ বার)।
* ওয়ানডেতে এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড, ৯৬টি (পাকিস্তানের বিপক্ষে)।