আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনে উজ্জীবিত বিএনপি। চাঙা নেতাকর্মীরা। হামলা-নির্যাতন সব বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে বাড়ছে তাদের উপস্থিতি। গণসমাবেশ রূপ নিচ্ছে জনস্রোতে। এতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে বাড়ছে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস।
এক যুগের বেশি ক্ষমতার বাইরে দলটি। সারা দেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা। হামলা-মামলা বিপর্যস্ত দলটি নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। দেশে বিএনপি নেই বলে যারা নানা সময়ে সমালোচনায় ব্যস্ত ছিল তাদের মুখেও এখন উলটো সুর। বিএনপির এ উত্থানের পেছনে কি ‘টনিক’ রয়েছে সে আলোচনাই সর্বত্র। দলটির নীতিনির্ধারক ও বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মূলত তিন কারণে উজ্জীবিত দলটি।
এগুলো হচ্ছে-১. সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জনমনে সৃষ্ট চাপা ক্ষোভ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামলেই জনগণও এতে সাড়া দেবে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সমাবেশে নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
২. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বিদেশিদের অব্যাহত চাপ। আগের দুটি নির্বাচনের মতো এবার একতরফা ভোট করতে পারবে না ক্ষমতাসীনরা। আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। সবকিছু মিলে ‘এবার কিছু একটা হবে’-এমন আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। ৩. সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গড়ে তোলা হচ্ছে বৃহত্তর ঐক্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সব দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় ক্ষমতাসীনরা সহজেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারবে না।
বিগত সময়ে যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারা খোলস থেকে রাজপথে নেমে আসছেন। শুধু নেতাকর্মী নয়, দলটির সমর্থকরাও এখন অংশ নিচ্ছেন নানা কর্মসূচিতে। ২২ আগস্ট থেকে জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে তৃণমূলে বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করে বিএনপি। এসব সমাবেশে অনেক জায়গায় হামলার শিকার হন নেতাকর্মীরা। জারি করা হয় ১৪৪ ধারাও। কিন্তু হামলা এমনকি কোথাও কোথাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে তারা। অতীতে পুলিশ দেখে নেতাকর্মীরা পালালেও এখন পালটা রুখে দাঁড়াচ্ছে। তৃণমূলের পর রাজধানীর ১৬টি স্পটে বিক্ষোভ সমাবেশেও ছিল নেতাকর্মীর ঢল। কয়েকটি স্থানে ক্ষমতাসীনরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে বিএনপি নেতাকর্মীরা পালটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজধানীর কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর ১০ বিভাগীয় সমাবেশে গণসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এ দুটি গণসমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি সবাইকে চমকে দিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বাধা ও গণপরিবহণ বন্ধের পরও এমন উপস্থিতিতে দল উজ্জীবিত। সবার মধ্যেই ‘ডু অর ডাই’ মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। নেতাকর্মীদের এমন উদ্দীপনা আগামী দিনে রাজপথের কর্মসূচিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের ধারণা ছিল মামলা-হামলা নির্যাতন করে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। কারণ বিএনপি গণমানুষের দল। সাংগঠনিকভাবে শক্ত ভিত রয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতনের পরও একজন নেতাকর্মীও দল ছেড়ে যায়নি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি নেতাকর্মীরা কতটা আস্থাশীল তা প্রমাণিত।
তিনি বলেন, সরকারের দুঃশাসনে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। মানুষের ভোটের অধিকার নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তারা দিশেহারা। সাধারণ মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে উপলব্ধি হয়েছে, যে কোনো মূল্যে এ দুঃশাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। তারা নিজেদের জীবনের কথা ভাবছে না। যে কোনো ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে কোনো কিছুই তাদের আটকাতে পারছে না।
‘ওয়ান-ইলেভেন’র পর দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সিনিয়র নেতাদের নামে মামলা এবং গ্রেফতারে চরম বিপর্যয় নেমে আসে বিএনপিতে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন দলটির নেতাকর্মীরা। তৃণমূলকে চাঙা করতে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাক্সিক্ষত সফলতা পায়নি। ওই সময় দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এক পর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে দল গোছানোর দিকে নজর দেয় হাইকমান্ড। কিন্তু নানা কারণে সেখানেও সফল হয়নি তারা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর নেতাকর্মীদের মনোবল একেবারে ভেঙে পড়ে। নেতাকর্মীদের চাঙা করতে দফায় দফায় বৈঠক করে হাইকমান্ড।
জানা গেছে, দল পুনর্গঠনে নেওয়া হয় বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্বান্ত। ভেঙে দেওয়া হয় জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে চলা সিন্ডিকেট। সব কমিটিতে যোগ্য, তরুণ ও সাহসীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনা হয়। অতীতে কমিটি পুনর্গঠনের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হতো তারা ঠিকমতো কাজ করেনি বলে অভিযোগ ছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেজন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়। তাই কেউ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। দল গোছানোর পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনের কৌশল নিয়ে কয়েক দফা তৃণমূল নেতাদের মতামত নেওয়া হয়। এসব বৈঠকে আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন। কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে অনেকেই মাঠে নামে না। তৃণমূল নেতারা জানান, এবারের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে। তারা সামনে থাকলে নেতাকর্মীরা যে কোনো ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামবে। তৃণমূলের এমন আহ্বানে কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের সামনে শপথ করেন যত বাধাই আসুক এবার আন্দোলনে তারা সামনের সারিতে থাকবে। কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন ঘোষণায় তৃণমূলের নেতাকর্মী উজ্জীবিত হয়।
কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজপথে সক্রিয় করতে নানা উদ্যোগ নেয় হাইকমান্ড। অতীতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি পালন করত। ফলে দেখা যেত অনেক জায়গায় কর্মসূচি পালিত হয়নি। আবার কোথাও কোথাও ফটোসেশন করেই দায়িত্ব শেষ করত। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসে দল। কেন্দ্র ঘোষিত তৃণমূলের কর্মসূচিতে সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলায় জেলায় দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। শুধু কর্মসূচি পালন নয়, তৃণমূলের কোথাও কোনো কোন্দল রয়েছে কিনা-তা নিরসনেরও দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের। প্রতিটি কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাহস জোগায়। যারা দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল তারাও কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, তৃণমূলের ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতারা। এতেও তাদের মধ্যে একটা উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহত নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে সেভাবে দাঁড়ায়নি কেন্দ্র। কিন্তু এবারের চিত্র উলটো। বিগত সময় যারা নিহত ও আহত হয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে হাইকমান্ড। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে অনেকে ঝুঁকি নিয়েই নামছেন রাজপথে।
বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা জানান, আগামী নির্বাচন অতীতের মতো একতরফা হবে না-এমন একটা আত্মবিশ্বাস সবার মধ্যেই তৈরি হয়েছে। এবার ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে এমন আশায় নেতাকর্মীরা ঝুঁকি নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, এবার আন্দোলনে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে বিএনপির রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে। মামলা-হামলায় দেশে থাকাই দায় হবে। আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এলে নেতাকর্মীদের বেশিরভাগকেই কাটাতে হতে পারে জেলখানায়। বর্তমানের চেয়ে নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। তাই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য রাজপথে নামা ছাড়া বিকল্প নেই।
তারা মনে করেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার বিদেশিদের চাপে রয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চায়। যেসব দেশ সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল তারাও এবার আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিদেশিদের চাপের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরণে একটা গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হলে সরকার বেকায়দায় পড়ে যাবে। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলে ফলাফল কী হবে তা সবাই জানে। এমন নানা সমীকরণ থেকে নেতাকর্মীরা রাজপথে সক্রিয় হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সরকারবিরোধী দলগুলোও মনে করছে এবার সহজেই যেনতেন নির্বাচন করতে পারবে না ক্ষমতাসীনরা। এমন ধারণা থেকে ডান-বাম-ইসলামপন্থি দলগুলোও বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে একমত হয়েছে। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সবাই মিলে রাজপথে নামলে এবার একটা ইতিবাচক ফল আসবে বলে মনে করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা।
জানতে চাইলে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। দেওয়ালও অনেক উঁচু। এটা টপকানো সম্ভব নয়। তাই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য সব বাধা উপেক্ষা করে তারা সামনে এগোচ্ছে। কোনো কিছুই তাদের আটকাতে পারছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে হটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না করে নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরবে না।