কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে সরকারের ‘অনমনীয়’ মনোভাবে হতাশ বিএনপি। আওয়ামী লীগ নেতারাও এ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর বক্তৃতা-বিবৃতির ক্ষেত্রেও সতর্ক অবস্থানে চলে গেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। নীতিনির্ধারক নেতারাও এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলছেন না।
অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, প্রধানমন্ত্রীর কঠোর মনোভাবের পর সরকারের সঙ্গে অপ্রকাশ্য কোনো ‘সমঝোতা’ করেও খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া সম্ভব নয়। এ অবস্থায় আন্দোলন ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথও খোলা নেই। আর আন্দোলন করতে হলে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। দলকে শক্তিশালী করে রাজপথে নামার পক্ষে দলের নীতিনির্ধারকরাও। পাশাপাশি তারা চেষ্টা করছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পরিধি বাড়াতে। এক্ষেত্রে সরকারবিরোধী বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার মধ্যে অন্যতম দাবি থাকবে খালেদা জিয়ার মুক্তি।
দুর্নীতির দুই মামলায় দ নিয়ে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদসহ তিনজন সংসদ সদস্য গত মঙ্গলবার সেখানে তার সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, জামিন পেলে খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন। বুধবার দলের আরও চার এমপি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর তার জামিন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘পদক্ষেপ’ কামনা করেন। একই দিন বিষয়টি নিয়ে তারা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলেন।
এর পর থেকেই খালেদা জিয়ার জামিনের প্রসঙ্গটি নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে বুধবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, খালেদা জিয়ার বিষয়ে কোনো আপস করা হবে না। একই সঙ্গে এ নিয়ে কোনো কথাবার্তা না বলার জন্য দলের নেতাদের সতর্কও করেন তিনি। এমন প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য সমঝোতার আর কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের কঠোর মনোভাবের বিষয়টি জানতে পেরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও বক্তৃতা-বিবৃতির ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে গেছেন। এ নিয়ে এর আগে দলের নেতাদের একেক জন একেক রকম বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার একাধিক জায়গায় এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সব নেতাই বিষয়টিকে ‘আদালতের সিদ্ধান্তের’ ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, খালেদা জিয়া জামিন পেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো বার্তা দেননি। বিএনপি যেটা চায়, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্দেশও পাননি তিনি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
দলের প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি পুরোপুরি আইনি বিষয়। কারণ তিনি দুর্নীতি মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত আসামি। রাজনৈতিক কারণে বন্দি কাউকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করার বিষয় থাকে। সুতরাং খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। বুধবার রাতের দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের এই মুখপাত্র।
অন্যদিকে, দলীয় চেয়ারপারসনের জামিন প্রশ্নে সরকারের অনমনীয় মনোভাবে অনেকটাই হতাশ বিএনপির নেতাকর্মীরা। সেইসঙ্গে দলের নেতারা এ নিয়ে হঠাৎ কেন ‘সরব ভূমিকা’ নিলেন তা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। এই প্রক্রিয়া সত্যিকার অর্থেই খালেদা জিয়ার জামিন প্রসঙ্গে তাদের ‘আন্তরিকতা’ নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, তা নিয়েও সন্দিহান অনেকেই। আবার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে দলের সর্বোচ্চ হাইকমান্ড বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জড়িত রয়েছেন বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
কয়েকজন নেতা বলছেন, বিএনপি নেতারা এর আগে খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে একেক সময়ে একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন। যা জাতিকে যেমন বিভ্রান্ত করেছে, ঠিক তেমনি এই বক্তব্যের সঙ্গে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ রাজনীতিরও কোনো মিল নেই। এর পরও ‘শারীরিক অসুস্থতার’ কারণে তাকে বিদেশ যাওয়ার জন্য রাজি করানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন কোনো কোনো নেতা। কিন্তু দলের সাত এমপির দু’দিনের দৌড়ঝাঁপ শেষে সরকারের কঠোর অবস্থানে রাজনৈতিক চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। এতে হতাশ হয়ে পড়ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে মাত্র নয় মাস আগে। আর বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে যোগ দিয়েছেন ছয় মাস হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দলীয় এমপিরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেননি। হঠাৎ করে কেন এবং কোন উদ্দেশ্যে অসুস্থ চেয়ারপারসনের সঙ্গে তারা দেখা করলেন এবং কেনই বা তার চিকিৎসার জন্য ‘বিদেশ পাঠানো’ সংক্রান্ত বক্তব্য দিলেন, তা তাদের জানা নেই। কার পরামর্শে তারা এটা করেছেন- সে সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা নেই।
তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া কারও অনুকম্পায় মুক্তি চান না। আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া জামিন না পেলে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে মুক্ত করা হবে। তার ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্পষ্টতা দূর হয়েছে। তবে কবে নাগাদ আন্দোলন হবে আর কবে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন, তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলনের বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন এখন সারাদেশের নেতাকর্মীদের দাবি। তারা আন্দোলনের মধ্যেই আছেন। এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করা হবে।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় দি ত ৭৩ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মাসের বেশি সময় কারাগারে রয়েছেন। গত ১ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করা হয়।





