আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী লাবিবুর রহমান। মামুলি গোছের একটা বাক্স বানিয়েছে সে। অথচ সে বাক্সতে চুম্বকের সাহায্যে ফ্যান ঘোরানো, লেজার লাইট জালানো, মোবাইল স্ট্যান্ডসহ নানান সুবিধা আছে। এমন ভাবনাকে উদ্ভাবনী প্রকল্প আকারে বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে এনে লাবিব পেয়েছে ‘বিজ্ঞানচিন্তা-বিকাশ বিজ্ঞান উৎসব’-এর সেরা বিজ্ঞান প্রকল্পের পুরস্কার। জিতে নিয়েছে ল্যাপটপ, ট্রফি, বইসহ নানা পুরস্কার।
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের মিলনায়তনে ‘বিজ্ঞানচিন্তা-বিকাশ বিজ্ঞান উৎসব’ জাতীয় পর্বের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়ে। দিনব্যাপী প্রতিযোগিতা, কুইজ ও বিজ্ঞানের নানা পর্বের মধ্য দিয়ে উৎসব শেষ হয়। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান বিকাশ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক মাসিক পত্রিকা ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।এবার উৎসবের স্লোগান ছিল, ‘বিজ্ঞানে বিকাশ’।
বিজ্ঞান প্রকল্প প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে বরিশাল জিলা স্কুলের আহাদুল ইসলাম, সামিন আহমেদ ও নাসিফ মাহমুদ এবং তৃতীয় হয়েছে বগুড়ার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সৈয়দ সাদ বিন হায়াত, মো. মাস্ফি জুনায়েত ও সুলতানা সারওয়াতরা। এদিকে কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে-মাধ্যমিক গ্রুপে: ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলের জান্নাতি আক্তার, খুলনা জিলা স্কুলের মো. তাহমিদ খান ও ব্লু বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওয়াকিয়া রহমান। আর নিম্নমাধ্যমিক গ্রুপের বিজয়ীরা হলো-বরিশাল জিলা স্কুলের ধ্রুব মণ্ডল, নারায়ণগঞ্জ আইডিয়াল স্কুলের জারিফ আহমেদ ও খুলনা জিলা স্কুলের এস এম আব্দুল ফাত্তাহ।
বিশেষ কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে-গভর্নমেন্ট করনেশন গার্লস স্কুলের নুসাইবা হাকিম, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের আহসানুর রাজী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নাবিল মোসাদ্দেক, নারায়ণগঞ্জ আইডিয়াল স্কুলের মুহাম্মদ আহনাফ ইসলাম ও মেরি কুরি স্কুলের সাফওয়ান মুহতাসিমুল হক।
এ বছরের ১৯ এপ্রিল ঢাকায় আঞ্চলিক পর্বের মধ্য দিয়ে এ বিজ্ঞান উৎসবের যাত্রা শুরু। ৭টি আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীরা আজ জাতীয় পর্বে অংশ নেয়। কাকডাকা ভোর থেকেই উৎসবস্থলে হাজির হয় সারা দেশে থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। কেউ অভিভাবকের সঙ্গে, কেউবা শিক্ষকের সঙ্গে এসেছে। ৬ ষ্ঠ-১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ৬০টি বিজ্ঞান প্রকল্প প্রদর্শন করে এবং অংশ নেয় কুইজে জুনিয়র ও সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে ভাগ হয়ে। ব্যবসায়ী ফজলে রাব্বী এসেছেন তাঁর নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে। বললেন, বাচ্চাদের বিজ্ঞান নিয়ে কত আগ্রহ তা এই উৎসবে এসে দেখলাম। আমাদের সময় তো এসব আয়োজন ছিল না। এমন আয়োজন আরও হওয়া উচিত।’
উৎসবে প্রদর্শিত প্রকল্পগুলো দৈনন্দিন জীবনে নানা সমস্যার সমাধান সংক্রান্ত। যেমন, রাজশাহী সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুনাজিয়া স্নিগ্ধার প্রকল্পটি ছিল পলিথিন বর্জ্য পুড়িয়ে তা থেকে তেল ও কালি উৎপাদন, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের এক শিক্ষার্থীর বানানো ‘রোবট কুইন’, বগুড়ার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুলের তিন শিক্ষার্থীর বানানো বাঁক-প্রতিবন্ধী সহায়ক যন্ত্র।
সকালে জাতীয় পর্বের উদ্বোধনীতে জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার কাজী শামীম ফরহাদ, বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির, ‘বিজ্ঞানচিন্তা’র সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন, রোবোটিকস ও মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল এবং বন্ধুসভার সভাপতি সাইদুজ্জামান রওশন।
উদ্বোধনের পর মিলনায়তনে শুরু হয় রোবট শো। রোবট আলফা নামের চার রোবট ভাই একসঙ্গে নেচে দেখায় গানের তালে। চার রোবটের নৃত্যের তালে দর্শক সারিতে থাকা শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়। এরপর মঞ্চে আসে শিল্পী অটামনাল মুন। তিনি গীতিকার কবির বকুলের লেখা বিজ্ঞানচিন্তার থিম সংসহ দুটি গান গেয়ে শোনায়। এরপর মঞ্চে গ্র্যান্ড মাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে দাবার যুদ্ধে নামে ১০ শিক্ষার্থী। একই সময়ে এই গ্র্যান্ড মাস্টার দশজনের সঙ্গে দাবা খেলেন। তবে কেউ এই দাবাড়ুকে হারাতে পারেনি। দাবার পর হয় আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীদের নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা ও বিশেষ কুইজ প্রতিযোগিতা।
এরপর হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। শিক্ষার্থীদের করা বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রেজাউর রহমান, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, ফিজিকস অলিম্পিয়াডের কোচ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খলিলুর রহমান, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান, বায়োলজি অলিম্পিয়াডের কোচ সৌমিত্র চক্রবর্তী, চিকিৎসক তানজিনা হোসেন, বিজ্ঞানবক্তা আসিফ ও বিকাশের রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের প্রধান হুমায়ন কবির।
মিলনায়তনে যখন একের পর এক অনুষ্ঠানপর্ব চলছিল, তখন মিলনায়তনের বাইরে চলছিল প্রকল্প প্রদর্শনী। মেলার মত করে বানানো স্টলগুলোতে ছিল বিজ্ঞানবাক্স; প্রথমা ও বাতিঘর বিজ্ঞানের বিচিত্রসব বইয়ের পসরা সাজিয়েছিল তাদের স্টলে। ছিল ডাকটিকিট প্রদর্শনী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বানানো রোবট ‘মঙ্গলতরী’ ও ‘রেসকিউবট’।
দুপুরের বিরতির পর উৎসব শুরু হয় রেসিডেনসিয়ালের মাঠে ওয়াটার রকেট উড়িয়েছিলেন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সদস্য মনন মাহমুদ ও তাঁর দল। এরপর মিলনায়তনে জাদু দেখান স্বপন দিনার। জাদুর ঘোর কাটতে না কাটতেই মঞ্চে আসেন অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘বিজ্ঞান জীবনকে সহজ করে। তাই তোমরা জীবনকে সহজ করার জন্য বিজ্ঞান ব্যবহার করবে।’
তিশার পর মঞ্চে আসে গানের দল জলের গান। দলটি ছয়টি গান গেয়ে শোনায়। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও দর্শনার্থীরা যোগ দেয় জলের গানের পরিবেশনা ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটির সঙ্গে। সবশেষে বিজ্ঞানের মজার খেলা দেখায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সদস্য ওমর ফারুক ও হাসান নাহিয়ান।
উৎসব শেষ হয় পুরস্কার বিতরণী ও সেলফি হিড়িকের মাধ্যমে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ, অধ্যাপক আরশাদ মোমেন। উৎসবে বিনামূল্য আইসক্রিম দেয় লাভেলো। স্মারক পুরস্কার দেওয়া হয় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধাক্ষ্য মো. মনজুরুল হক।