বাংলাদেশকে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা মিলে বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেখান থেকে ৪ হাজার ৯৫৪ কোটি ডলার পাইপলাইনে আটকে আছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
বর্তমান বিনিময় হার (১ ডলারে ৮৫ টাকা) অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দাতাদের কাছে বাংলাদেশের পাওনা হিসেবে ধরা হয়।
দাতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত এই অর্থের সার্ভিস চার্জও পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ এই বিপুল অর্থ বাংলাদেশের সম্পদ।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।
সে হিসাবে দাতাদের কাছ থেকে পাইপলাইনে পড়ে থাকা অর্থ বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের প্রায় কাছাকাছি।
ইআরডির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতি বছর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার দাতাদের সঙ্গে যেসব ঋণ চুক্তি করেছে, সেসব প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারায় বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ও দাতারা সময়মত করছে না।
পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত পাঁচ বছর ধরে দাতাদের সঙ্গে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার কোটি ডলার করে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। অথচ ছাড় করতে পেরেছে মাত্র ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার।
এভাবে একদিকে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থ ছাড় করতে না পারা, অন্যদিকে বেশি পরিমাণে চুক্তি স্বাক্ষর করার ফলে প্রতি বছর নতুন করে পাইপলাইনে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার। এসব মিলে পাইপলাইনের আকার প্রতিবছরই বড় হচ্ছে।
ইআরডির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুন বা গত ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দাতা দেশ ও সংস্থার সঙ্গে চুক্তির অর্থ থেকে ৪ হাজার ৯৫৪ কোটি ডলার পাইপলাইনে আটকা পড়েছে।
গেল অর্থবছর সরকার দাতাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে ৯৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের। সেখানে ছাড় হয়েছে ৭২৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
অর্থাৎ ওই অর্থবছরে যত প্রতিশ্রুতি আদায় করা গেছে তার চেয়ে ২২৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার কম ছাড় হয়েছে। ফলে ওই অর্থ দাতাদের কাছে পুঞ্জিভূত পাওনার খাতায় যুক্ত হয়েছে।
একইভাবে তার আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার দাতাদের সঙ্গে চুক্তি করে ৯৯০ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের। কিন্তু ছাড় হয়েছে মাত্র ৬৫৪ কোটি ২৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই অর্থবছরেও প্রতিশ্রুতির তুলনায় ৩৩৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার কম ছাড় হয়েছে। ফলে ওই অর্থ দাতাদের কাছে পুঞ্জিভূত পাওনা বা পাইপলাইনে চলে যায়।
এভাবে প্রতি বছর দাতাদের কাছ থেকে ছাড়ের তুলনায় বেশি প্রতিশ্রুতি আদায় করে চুক্তি করার ফলে পাইপলাইনের আকার দিন দিন বড় হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির ফরেন এইড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস (ফাবা) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব পিয়ার মোহাম্মদ বলেন, “বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থ ছাড় বাড়ানোর জন্য ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের তালিকা করে ইআরডি ওই সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন মনিটর করছে। এছাড়াও বাস্তবায়নকারী সংস্থা, ইআরডি এবং দাতা সংস্থা মিলে প্রতি তিন মাস পরপর ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা হয়।
“সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই পাইপলাইনের অর্থ ব্যয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে আমাদের কাছে তথ্য চেয়েছে। এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। ওই কমিটি পরিকল্পিত উপায়ে পাইপলাইনের অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেবে।”
তিনি বলেন, বিশেষ করে যেসব প্রকল্পের গতি নেই সেসব প্রকল্পে গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে পাইপলাইনের অর্থ ব্যয় করা হবে।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “পাইপলাইনের প্রায় সকল অর্থই আসলে প্রকল্প সহায়তার। তাই পাইপলাইন কমাতে হলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়াতে হবে।”
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলোকে বাছাই করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।”
এজন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আবার সংশ্লিষ্ট লোকবল সংক্রমিত হলে দাতারা আপত্তি করতে পারেন।”
বৈদেশিক সহায়তা বেশি এমন প্রকল্প বাছাই করে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে সরকারকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন তিনি।