শহরে কিংবা গ্রামে, বিদ্যুতের ভুলভাল বিলিং অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক মাসে যে বিদ্যুত্ ব্যবহার করছেন তার পরিবর্তে যে পরিমাণ ব্যবহার করেননি, সেটারই বিল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অসংখ্য গ্রাহককে। বিশাল অঙ্কের ভূতুড়ে বিল দেখে অনেকে অতিষ্ঠ, আবার গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো হয়ে পড়েন আতঙ্কিত। এ ধরনের ভুলের শিকার হলে কেউ প্রতিকার পান আবার কেউ পান না। হয়রানি কিংবা বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে অনেকে ভূতুড়ে বিলই পরিশোধ করে দেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর এ ধারা চললেও সমাধান মিলছে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্রাহকদের নিজেদেরকেই এ ভুল এবং জালিয়াতি বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে। আর যতদিন সব গ্রাহকের আঙ্গিনায় প্রিপেইড মিটার না বসছে ততদিন এ অসংগতি ও হয়রানির টেকসই সমাধানও হবে না।
জানা গেছে, গ্রাহক যে পরিমাণ বিদ্যুত্ ব্যবহার করে সেই স্লটের ওপর বিদ্যুত্ বিল নির্ধারণ করে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো। এর সঙ্গে ডিমান্ড চার্জ এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যুক্ত হয়। একজন গ্রাহক যত বেশি পরিমাণ বিদ্যুত্ ব্যবহার করেন তার মাসিক বিল তত বেশি মূল্যহারে নির্ধারিত হয়। লাইফ লাইনসহ (৫০ বা তার চেয়ে কম ইউনিট ব্যবহারকারী) সাত শ্রেণিতে গ্রাহকদের ভাগ করেছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সে অনুযায়ী মাসে ০ থেকে ৭৫ ইউনিট (কিলোওয়াট) পর্যন্ত বিদ্যুত্ ব্যবহার করলে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ১৯ পয়সা হারে বিল দিতে হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের (৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট) প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৭২ পয়সা, তৃতীয় ধাপে (২০১ থেকে ৩০০) ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপে (৩০১ থেকে ৪০০) ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, পঞ্চম ধাপে (৪০১ থেকে ৬০০) ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুত্ ব্যবহারকারীদের ষষ্ঠ ধাপের গ্রাহক হিসেবে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা হারে বিল শোধ করতে হয়। একজন গ্রাহক মাত্র ১ ইউনিট বিদ্যুতের কারণে পরের ধাপের বিলিংয়ে পড়ে যেতে পারেন। এতে তার টাকার অঙ্কেও হতে পারে ব্যাপক তারতম্য। তাই মিটার রিডাররা চাইলেই ইউনিট কমবেশি লিখে ভূতুড়ে বিলের ফাঁদে ফেলে দিতে পারে যে কোনো গ্রাহককে।
প্রতি মাসে গ্রাহকদের ঘরে ঘরে গিয়ে মিটার দেখে বিল প্রস্তুত করার দায়িত্ব বিতরণকারী সংস্থাগুলোর। কিন্তু কয়েক জন ভুক্তভোগী গ্রাহক এবং কয়েক জন জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি জানান, প্রতি বছরই একটি বড় সংখ্যক গ্রাহক ভূতুড়ে কিংবা অতিরিক্ত কিংবা ভুল বিলিংয়ের শিকার হন। অনেকে ভোগান্তি এড়াতে অভিযোগও করেন না।
গ্রাহকরা জানান, শীত এবং গরমকালভেদে বিদ্যুত্ ব্যবহারে পার্থক্য হয়। শীতকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) এবং ফ্যানের ব্যবহার কম হওয়ায় বিদ্যুতের ব্যবহারও কমে। আর গরমে সেটি বেড়ে যায়। গ্রাহক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ধরা যাক—একটি বাসায় প্রতি মাসে ৪০০ ইউনিটের মধ্যে বিদ্যুত্ ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে। সে হিসেবে ডিমান্ড চার্জ ও ভ্যাট ছাড়া ঐ বাসার বিদ্যুত্ বিল আসবে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৩৬ টাকা। কিন্তু মিটার রিডার দুই মাস রিডিং না নিয়ে বা মিটার না দেখে তার মাসিক বিল করল ৩৫০ ইউনিট ধরে। পরে তৃতীয় মাসে গিয়ে তিনি আগের দুই মাসের সঞ্চিত ১০০ ইউনিট ঐ মাসের সঙ্গে যোগ করে ৫০০ ইউনিটের বিল তৈরি করলেন। ব্যবহারের এ পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে গ্রাহক চতুর্থ থেকে পঞ্চম ধাপের গ্রাহক হিসেবে হাতে বিল পান। অথচ প্রকৃত অর্থে তিনি চতুর্থ ধাপের গ্রাহক।
দায়িত্বে অবহেলাজনিত এ বিলিং জালিয়াতির কারণে ঐ গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৩৪ পয়সার পরিবর্তে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা হারে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাত্ ২ হাজার ৫৩৬ টাকার পরিবর্তে ৪ হাজার ৯৭০ টাকা বিল দিতে হবে। মিটার রিডার আগের দুই মাসের জমে থাকা ইউনিট এই মাসে ঢুকিয়ে দেওয়ার কারণে খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেল। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করা কঠিন। সে কঠিন দায়ই বছরের পর বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন অগণিত গ্রাহক।
এমনই এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন রাজধানীর মিরপুর-২-এর বসতি হাউজিংয়ের ২ নম্বর রোডের টিউলিপ ভবনের একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এ বি এম সাদেক। তিনি জানান, মিটার রিডার চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসে তার বিলে ব্যবহূত ইউনিট দেখিয়েছে যথাক্রমে ২৯৯, ২৬৭, ৩২০, ৩৮৪ এবং ২৯৯। এ মাসগুলোতে বিলের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৭৫৫ টাকা, ১৫৬৩ টাকা, ১৮৮৭ টাকা, ২৪২৮ টাকা এবং ১৭৫৫ টাকা। অথচ এ সময়ে তার প্রকৃত ব্যবহার আরো বেশি ছিল। এরপর জুন এবং জুলাই মাসের বিলে আগের ঐ মাসগুলোর সঞ্চিত ইউনিটগুলো যুক্ত করে যথাক্রমে বিল করা হয় ১ হাজার ৮৯৮ ইউনিটের এবং ১ হাজার ১০৩ ইউনিটের। ফলে জুন মাসের বিল দেখানো হয় ২০ হাজার ২৪০ টাকা এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৭৫ টাকা।
ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) এ গ্রাহক অভিযোগ করেন, স্থানীয় মিটার রিডার নিয়মিত মিটার রিডিং দেখেন না। খেয়ালখুশি মতো বিলের ইউনিট বসান। পরে তার ইচ্ছেমতো একদিন এসে কয়েক মাসের জমে থাকা ইউনিট এক মাস বা দুই মাসের বিলের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। দায়িত্বে এ ধরনের অবহেলার কারণে গ্রাহকদের পকেট থেকে একটি বড় অংশের অর্থ বের হয়ে যায়। এটি গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতি।
এ প্রসঙ্গে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, মিটার রিডিংয়ের ব্যাপারে আমাদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি গ্রাহকদেরও দায়িত্ব আছে সচেতন হয়ে সঠিক ইউনিট অনুযায়ী বিল বুঝে নেওয়ার। কোম্পানির প্রতিনিধি ভুল করলে সেটি গ্রাহক ধরিয়ে দিতে পারেন। প্রতিটি মিটারের সঙ্গে মিটার কার্ড দেওয়া থাকে। সেটিতে মিটার রিডারের প্রতি মাসের রিডিং লিপিবদ্ধ করার নিয়ম রয়েছে। গ্রাহক এটি সংরক্ষণ এবং মিটারের সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই এই ভুল এড়িয়ে যাওয়া বা সংশোধন করা সম্ভব হয়। আর স্থায়ী সমাধানের জন্য সব গ্রাহককেই প্রিপেইড মিটার দেওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে সব গ্রাহকের আঙিনায় প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হবে।
তবে সম্প্রতি এ প্রতিবেদক রাজধানীর ধানমন্ডি, শাহবাগ, রামপুরা, মিরপুর এবং ঢাকার বাইরের জেলা কুমিল্লা, চাঁদপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কয়েক জন গ্রাহকের আঙিনায় মিটারের সঙ্গে কোনো মিটার কার্ড দেখেননি। বিদ্যুত্ বিভাগের নীতি পরিকল্পনা ও বিশ্লেষণ সহযোগী সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সম্প্রতি বিদ্যুতের ভূতুড়ে বিলের অভিযোগ সমাধান করতে গিয়ে এ সমস্যাটি আমরাও শনাক্ত করেছি। এ ভুল এড়ানোর একটাই টেকসই সমাধান, আর তা হলো—প্রিপেইড মিটার স্থাপন। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিলের ব্যাপারে বড় রকমের বিশৃঙ্খলা আছে। ঢালাওভাবে বিল করে গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঠকানো হচ্ছে গ্রাহকদের।