শেয়ারবাজারে লাগাতার দরপতনে বিনিয়োগকারীদের চোখের সামনে লাখ লাখ টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। গতকাল এক দিনের দরপতনেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। পুঁজি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা গত কয়েক দিনের মতো গতকাল সোমবারও মতিঝিলে ডিএসই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। দরপতন রুখতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় তারা শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) দুষছেন। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ বা তাকে অপসারণের দাবিও করেছেন তারা।
বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য বেশ কয়েকটি প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। এ বাজারের উন্নয়নে সরকার যে অত্যন্ত আন্তরিক তা বারবার বলা হচ্ছে। তারপরও বাজারের পতন কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ের দরপতন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গতকালের দরপতন গত এক বছরের সর্বোচ্চ। সোমবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৫২ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩০৩টিরই দরপতন হয়েছে। অর্থাৎ দর হারিয়েছে ৮৬ শতাংশ শেয়ার, বিপরীতে বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশের। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গতকাল এমন একটি খাত ছিল না, যেটিতে দরপতন মাত্রা ছাড়ায়নি।
এমন দরপতনে এক দিনেই বাজারের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্সের পতন হয়েছে ৮৮ পয়েন্ট। এর আগে গত বছরের ২৫ জুন এক দিনে এতটা সূচক হারিয়েছিল বাজার। গতকালের দরপতনে সূচকটি আড়াই বছর আগের অবস্থানে ৫০৯১ পয়েন্টে ফিরে গেছে। সূচকের এ নিচের অবস্থানটি (৫০৮৩) ছিল ২০১৭ সালে ১ জানুয়ারি। একই চিত্র দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইতে। অব্যাহত দরপতনে শেয়ার কেনাবেচাও খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। গতকাল দুই বাজার মিলে ৩২০ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে।
দরপতনের এ চিত্র শুধু গতকালেরই নয়; এ চিত্র চলতি মাসের বা চলতি বছরের বা ২০১০ সালের পরের গত প্রায় ১০ বছরের। পতনের হিসাব করতে গিয়ে দেখা গেছে, শুধু চলতি জুলাইয়ের প্রথম ১৫ দিনে ৩১৬ কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে ২৪৫টিই দর হারিয়েছে, দর বেড়েছে মাত্র ৬৩টির। আবার এই ৬৩টির মধ্যে বীমা কোম্পানির শেয়ারই ৩৯টি। বীমার দরবৃদ্ধি আমলে নিলেও গত দুই সপ্তাহে বাজারের সব শেয়ার গড়ে প্রায় ৬ শতাংশ হারে দর হারিয়েছে।
শুধু গতকালের দরপতনে তালিকাভুক্ত সব শেয়ারের মূল্য (বাজারমূল্য) কমেছে সাত হাজার ১২৯ কোটি টাকা। আর শুধু চলতি জুলাইয়ের ১০ কার্যদিবসে কমেছে ২১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। এ লোকসান কোম্পানির মূল মালিকপক্ষ (উদ্যোক্তা-পরিচালক), সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর। শুধু গতকালই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লোকসান অন্তত দুই হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। এ মাসের অর্ধেকটাতেই লোকসান ছাড়িয়েছে আট হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। গত জুন শেষে তালিকাভুক্ত ৩১৭ কোম্পানির মোট শেয়ারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অংশ ছিল ৩৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এই হিসাবে লোকসান গণনা করা হয়েছে।
যেসব ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, সেই ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কর্মকর্তারা জানান, লোকসানে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। লোকসানের ভার বহন করার ক্ষমতা হারিয়ে অনেকেই শেয়ারবাজারে আসা ছেড়ে দিয়েছেন। লোকসান আরও বাড়তে পারে- এ আশঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।
গতকাল ঢাকার মতিঝিলের শেয়ারবাজার পাড়ার বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক ঘুরে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের বাইরে বিনিয়োগকারীদের খুব একটা দেখা মেলেনি। একাধিক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, লেনদেন এতটাই কমে গেছে যে তাদের ব্যবসাও কমে গেছে। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেকেই ব্রোকারেজ হাউস বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাও করছেন।
কিন্তু শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, তারা শেয়ারবাজারের অবস্থা ঠিক করতে সদা তৎপর। প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারসহ বাজারের উন্নতির জন্য বহু পদক্ষেপ নিয়েছেন। সরকারও এ বাজারের উন্নয়নে সব কিছু করছে। বাজার খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।
শেয়ারবাজারের কেন এ অবস্থা- এমন প্রশ্নে স্টক এক্সচেঞ্জ ও শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কমিশন অনেক নতুন আইন করছে, আবার পুরনো আইনের বহু সংস্কারও করেছে। এসব সংস্কার বাজারে সুশাসন ফেরাতে কোনো ভূমিকাই রাখছে না। উল্টো স্বার্থান্বেষী মহল ও কারসাজি চক্রকে সুযোগ করে দিচ্ছে। একের পর এক খারাপ কোম্পানির আইপিও দিয়ে বাজার সয়লাব হচ্ছে। বাজারে প্রতিনিয়ত কারসাজি হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
ডিএসই ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তীব্র। কয়েক বছর ধরে এখানে বিনিয়োগ করতে এসে কেউ পুঁজি নিয়ে ফিরতে পারছেন না। বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নতুন করে বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে পারছে না। পুরনোরা পুঁজি হারিয়ে ফেরত গেলে কী করে শেয়ারবাজার ভালো হবে- এমন প্রশ্ন তার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, সুশাসনের অভাব সর্বত্র। শেয়ারবাজার তার বাইরে থাকবে, এমন কোনো যুক্তি আমার কাছে নেই। এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। মূলত সুশাসন না থাকায় শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। দেশের অর্থনীতির তুলনায় শেয়ারবাজার খুবই ছোট। এ বাজার নিয়ে দেশের খুব কম মানুষই চিন্তা-ভাবনা করেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চলতি দরপতনের জন্য শেষ পর্যন্ত আস্থার সংকটকেই দায়ী করছেন বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, দরপতনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে কোনো কারণকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু দরপতন যখন দীর্ঘায়িত হয়, তখন নিশ্চিত করে বলা যায়, কোনো না কোনো কারণে বিনিয়োগকারীদের নতুন করে বিনিয়োগে আস্থা নেই। কেন এ আস্থার সংকট তা বাজার যারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদেরই খুঁজে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অবশ্য শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি মনে করে, চলতি দরপতনের জন্য চলতি কিছু ইস্যুর প্রভাব বেশি। এ বিষয়ে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান সমকালকে বলেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম অর্ধে গ্রামীণফোনের একই সঙ্গে মুনাফা ও অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ ঘোষণা কমার কারণে শেয়ারটির দরপতন হয়েছে, যা সূচকে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া কোম্পানিটির ওপর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার কর দাবির কারণেও বিনিয়োগকারীরা কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন। তাছাড়া পিপলস লিজিং নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোম্পানির অবসায়নের খবরে আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসবের সার্বিক প্রভাবে দরপতন হচ্ছে।
এসব ঘটনা খুবই সমসাময়িক, কিন্তু দরপতন হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে, কেন এ অবস্থা- এমন প্রশ্নে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, আর্থিক খাতে তারল্য সংকট রয়েছে। আর্থিক বাজারে নানা ঘটনায় শেয়ারবাজারে অস্থিরতা আছে। স্বাভাবিক কারণে বাজারে অর্থপ্রবাহ কমেছে। যার নেতিবাচক প্রভাবে শেয়ার চাহিদা কমছে। এ কারণেই হয়তো দরপতন হচ্ছে। চলতি দরপতন রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু করণীয় আছে কি-না, এমন প্রশ্নে সাইফুর রহমান বলেন, কমিশন সরাসরি বাজারে হস্তক্ষেপ করে না। ফলে প্রত্যক্ষভাবে দরপতন বন্ধে কমিশনের কিছু করার নেই। কমিশন মনে করে নানা সংকটের পরও নতুন করে এমন কোনো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যার কারণে লাগাতার দরপতন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এলে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত না হয়ে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা ও বাজারদর দেখে বিনিয়োগ করলে দরপতন হবে না। অচিরেই শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজার নানা সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে। দরপতন রুখতে আগে সংকটগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। এটা না হলে কখনও বাজারের এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না, বরং দিনে দিনে খারাপ হবে। বর্তমান সংকটগুলোর মধ্যে সুশাসনের অভাবই শেয়ারবাজারের প্রধান সংকট বলে মনে করেন আবু আহমেদ। তিনি বলেন, খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধেই বাজারের শৃঙ্খলা বিনষ্টের অভিযোগ উঠছে। এ নিয়ে প্রতিদিনই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু সংস্থাটি এসব আমলেই নিচ্ছে না। সরকারও তা এড়িয়ে চলেছে। উল্টো সরকারের শীর্ষ পর্যায় বাজারের সংকট সমাধানসহ প্রণোদনার আশ্বাস দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেনি। আবার প্রণোদনার নামে যেসব উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নিয়েছে তা বাজারকে আরও খারাপ করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার এ বিষয়টি আমলে না নিলে বাজার পরিস্থিতি ভালো হওয়ার সুযোগ কম বলেও মত দেন তিনি।