বিমানবন্দরে স্ক্যানার নষ্ট, সবজি যাচ্ছে না যুক্তরাজ্যে

পূর্ব লন্ডনের নিউ স্পিটালফিল্ডস মার্কেটে গত শনিবার দেশি সবজি খুঁজে পাচ্ছিলেন না প্রবাসী বাংলাদেশিরা, এমনটা কখনও হয় না দেখে অবাক হচ্ছিলেন তারা।

জানতে চাইলে ওই মার্কেটের আনিকা ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবলের মালিক আতিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ থেকে সবজি পাচ্ছেন না তারা। তাই বাজারে দেশি সবজি নেই।

কী কারণ- উত্তরে তিনি বলেন, “তারা (রপ্তানিকারকরা) বলছে, (শাহজালাল) এয়ারপোর্টে স্ক্যানার নষ্ট। একটা স্ক্যানার দিয়ে কীভাবে একটা দেশের এয়ারপোর্ট চলে?”

লন্ডনে সবজির সবচেয়ে বড় এই পাইকারি মার্কেটের ব্যবসায়ী আতিক বলেন, এই দুই সপ্তাহে তিনি একাই প্রায় ২০ হাজার পাউন্ডের অর্ডার ‘লস’ করেছেন।

সরবরাহের হতাশার কথা জানিয়ে মেরিডিয়ান ইউকে লিমিটেডের মালিক সোহেল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের অনেক সবজি যুক্তরাজ্যে এমনিতেই নিষিদ্ধ। এর মধ্যে যাও কিছু আসে সেটাও দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ।

তিনি দেখাচ্ছিলেন তার দোকানে বাংলাদেশের কলার থোর, লাউ, কচুমুখী, সুপারী, তালের একটি করে বক্স। ছুটির দিন শনিবার রাতে অন্তত প্রতিটির ৪০/৫০ বক্স থাকে।

নিউ স্পিটালফিল্ডস মার্কেট থেকেই যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বাংলাদেশি দোকানে সবজি যায়। এখন সবখানেই একই অবস্থা। ফলে দেশি সবজির স্বাদ নিতে পারছেন না প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের দোকানগুলোতে বছরে ১০ কোটি পাউন্ডের কৃষিপণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মোটে সোয়া ৩ কোটি পাউন্ডের পণ্য সরবরাহ পাঠাতে পারছেন দেশীয় ব্যবসায়ীরা। আর তুরস্ক, আফ্রিকা বা পূর্ব ইউরোপীয়সহ অন্যান্য দেশগুলোর মানুষের কাছে সবজির বাজার বাড়াতে পারলে তা ৫০০ মিলিয়ন পাউন্ডে দাঁড়াতে পারে বাজার।

ব্রিটিশ বাংলাদেশি ভেজিটেবল ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রফিক হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশি সবজির সরবরাহ খুবই অনিয়মিত। একদিন আসে তো কয়েকদিন আসে না। এর ফলে যুক্তরাজ্যে ক্রমাগত বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশের সবজি ও কৃষিপণ্য।

স্ক্যানার জটিলতায় ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ দেশি রপ্তানিকারকরাও। তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বাজার হারানোর শঙ্কা।
হজরত শাহজালাল ‍আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফাইল ছবিহজরত শাহজালাল ‍আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ফাইল ছবি
ঢাকার কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক উত্তম কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরের স্ক্যানিং মেশিন নষ্ট থাকায় ১০ দিনের মতো সবজি রপ্তানি বন্ধ।

তার ভাষ্যে, গত ছয় মাসে স্ক্যানিং মেশিন নষ্ট হওয়ার তৃতীয় ঘটনা এটি।

“এভাবে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়ে বাজার হারাচ্ছি আমরা। অন্য দেশের সরবরাহকারীদের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছেন ইউরোপের ব্যবসায়ীরা,” বলেন উত্তম।

যুক্তরাজ্যে রপ্তানি পণ্য তাদের অনুমোদিত স্ক্যানারের মাধ্যমে স্ক্যান করেই পাঠাতে হয়, নাহলে তারা তা গ্রহণ করে না বলে জানান বাংলাদেশ ফুড ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্ট এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সভাপতি এস এম এ জাহাঙ্গীর হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে এরকম দুটি স্ক্যানার ছিল। একটা স্থায়ীভাবে নষ্ট। আরেকটা কয়েকদিন পরপর নষ্ট হয়। একেকবার নষ্ট হলে ১৫ থেকে ২০ দিন রপ্তানি বন্ধ থাকে।

জাহাঙ্গীর বলেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একটা বিকল্প স্ক্যানার আছে, সেটা দিয়ে স্ক্যান করে কৃষিপণ্য সেসব দেশে যাচ্ছে। আর যুক্তরাজ্যের পণ্য সামান্য কিছু বহন করছে কাতার এয়ারওয়েজ। ঢাকা থেকে কাতারে নিয়ে সেখানে সেগুলো যুক্তরাজ্য অনুমোদিত স্ক্যানারে স্ক্যানিংয়ের পর যুক্তরাজ্যে পাঠানো হচ্ছে।

“কিন্তু কাতার সর্বোচ্চ দুই টন পণ্য নিতে পারে। আর তাদের ভাড়াও অনেক বেশি, যার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ওভাবে পণ্য বহন করে টেকাটা অনেকটা অবাস্তব।”

তিনি বলেন, “গত দুই-তিন বছর ধরে এই অবস্থা। আমরা চিঠিও দিয়েছি সিভিল এভিয়েশনকে। বারবার বলা সত্ত্বেও তারা উদ্যোগ নিচ্ছে না। যার কারণে আসলে দেশেরই ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।”

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের বাজারে অন্য দেশগুলো ঢুকে পড়লে পরে সেই বাজার পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

লন্ডনে সবজির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার পূর্ব লন্ডনের নিউ স্পিটালফিল্ডস মার্কেট।লন্ডনে সবজির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার পূর্ব লন্ডনের নিউ স্পিটালফিল্ডস মার্কেট।
ব্যবসায়ী মনসুর আহমেদ বলেন, “এভাবে থেমে থেমে তো পচনশীল খাদ্যপণ্যের ব্যবসা করা যায় না। যুক্তরাজ্যে মানুষ তো আর না খেয়ে আমাদের পণ্যের জন্য বসে থাকবে না।

“বাজারে ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার পণ্য ঢুকবে। ওইসব দেশের সরবরাহকারীরা একবার ওই বাজারে ঢুকে গেলে আমরা কি তাদের হটিয়ে দিতে পারব? এগুলা করতে করতে আমাদের পানের মার্কেটটা ইউকেতে নষ্টই হয়ে গেল।”

বিএফভিএপিইএ সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ, “স্ক্যানার ঠিক থাকলে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ টন মাল যেত। সিভিল এভিয়েশন এক কেজি পণ্য স্ক্যানিংয়ের জন্য ৬ সেন্ট করে নেয়। এক সপ্তাহের মাসুলের পয়সা দিয়ে এরকম চারটা স্ক্যানার কেনা যায়। কিন্তু সিভিল এভিয়েশন কোনো উদ্যোগই নেয় না। একটা মেশিন এক বছর থেকে পুরোই নষ্ট। আরেকটা কয়েকদিন পরপর খালি নষ্ট হয়।”

স্ক্যানার ঠিক করে যুক্তরাজ্যে কৃষিপণ্য পাঠাতে আরও দুই সপ্তাহের মতো লাগবে বলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান জানিয়েছেন।

তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ঠিক করতে যে পার্টস লাগবে সেটা পৌঁছালে পরে এটা মেরামত করা যাবে।”

বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাজ্যের পরিবহন দপ্তর (ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট) অনুমোদিত ওই ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন স্ক্যানার) এর যন্ত্রাংশ দেশে পাওয়া যায় না।

স্ক্যানার নষ্ট হওয়ায় যুক্তরাজ্যে পণ্য পাঠানো এখন সম্ভব না হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশে পণ্য পাঠানো স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান তৌহিদ আহসান।

Pin It