বিমান ছিনতাই চেষ্টা: ‘দুঃসাহসে’র নেপথ্যে কী ?

Untitled-48-5c7444589bff9-5c74549f32c98

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের পিরোজপুরের দুধঘাটার যুবক পলাশ আহমেদ। গতকাল সোমবার ভোরের আগে তার পরিচিতি ছিল ‘মাহাদী’ হিসেবে। রোববার চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-১৪৭ নম্বর ফ্লাইট ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে আলোচনার তুঙ্গে চলে আসে সে। গতকাল থেকে কথিত মাহাদীরের নাম-পরিচয় ও তার অতীত কর্মকাণ্ডের কথা উঠে আসতে থাকলে বিস্মিত হন সকলে। পিরোজপুরের এই যুবক কেন হঠাৎ ‘অস্ত্র হাতে’ ও ‘বোমাসদৃশ’ বস্তু শরীরে নিয়ে বিমান ছিনতাইয়ের মতো ‘দুঃসাহসিক’ আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামল, তা পরিস্কার নয় তার বাবার কাছেও। এমনকি পলাশের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে গোয়েন্দারা সন্দেহাতীত কোনো তথ্য পাননি। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ ঘটনায় জড়িত যুবক ‘বিষাদগ্রস্ত’ ছিল।

তবে পলাশ যে পুরোদস্তুর প্রতারক, তা তার অতীত কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট। ‘মাহিবি জাহান’ নামে নিজের ফেসবুকে প্রোফাইলে সে  ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে আইটি বিজনেস অ্যানালিস্ট হিসেবে কর্মরত বলে উল্লেখ করেছিল। জানিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগে পড়াশোনা করেছে। যদিও তার পরিবার সমকালকে জানান, সোনারগাঁয়ের স্থানীয় তাহিরপুর সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পাস করে পলাশ। এরপর সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়। প্রথম বর্ষের পরই হঠাৎ পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকায় যায় সে। ওই সময় ঢাকার চলচ্চিত্রপাড়ায় যাতায়াত শুরু করে সে। বিয়ে করেছিল অভিনেত্রী সিমলাকে। মাস চারেক আগে তাদের ডিভোর্স হয় বলে জানিয়েছেন সিমলা। পলাশ অভিনয় করেছিল ‘কবর’ নামে একটি শর্ট ফিল্মেও।

পলাশের বাবা পিয়ার জাহান সমকালকে বলেন, ছোটবেলা থেকে পলাশ ছিল বেয়াড়া প্রকৃতির। বাড়ির কারও কোনো কথা শুনত না। পড়াশোনা বন্ধ করে ২০১২ সালে ঢাকায় যাওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগও রাখত না সে। তবে পলাশ বিমান ছিনতাই করার চেষ্টা চালাবে- এটা তাদের কল্পনার বাইরে ছিল। যে ছেলে এমন অপকর্ম করে দেশের দুর্নাম করেছে তার লাশ আনতে চান না, মুখও দেখতে চান না বলে জানান তিনি।

বিমান ছিনতাইয়ের ব্যাপারে সমকালের কাছে নিজের বিশ্নেষণ তুলে ধরেছেন নিরাপত্তা বিশ্নেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী। তার মতে, ঘটনাপ্রবাহ বিশ্নেষণ করে মনে হয়ে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টায় সম্পৃক্ত যুবক কোনো না কোনো কারণে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিল। সেটা হতে পারে প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়ে, হতে পারে ব্যবসা ও ক্যারিয়ারে বিফলতার কারণে। ওই যুবক বিমান ধ্বংস করতে চায়নি। এমনকি কাউকে খুন করার কথাও বলেনি। সে প্রধানমন্ত্রী ও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। মনে হয়, মানসিক ভারসাম্যহীনতার জায়গায় থেকে সে কারও মনোযোগ চেয়েছে। সেটার জন্য সে ব্যাকুলতা দেখিয়েছে। এ ধরনের নজির বিশ্বে রয়েছে।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে ওই যুবক তার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষের কথাও বলেনি। উগ্রপন্থি বা অন্য কোনো সংগঠনের নামও বলেনি। তাই তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয় না। তাকে জীবিত বন্দি করা হলে হয়ত অনেক কিছু পরিস্কার হতো।

এ ব্যাপারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল সমকালকে বলেন, যথাযথ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কাউকে মানসিক ভারসাম্যহীন বা অবসাদগ্রস্ত বলে উপস্থাপন করা ঠিক হবে না। এতে অপরাধী তার কৃতকর্ম থেকে খালাস পেয়ে যেতে পারে। তবে তার পারিপার্শ্বিক যে ধরনের লক্ষণের কথা বলা হচ্ছে, সেরকম ডিপ্রেসনের ক্ষেত্র যে-কারও মধ্যে তৈরি হতে পারে।

এদিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী সিমলা বলেন, ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পলাশের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়। নিজের অভিনীত একটি চলচ্চিত্রের পরিচালকের বাসার এক অনুষ্ঠানে তাদের প্রথম পরিচয়। এরপর তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ৩ মার্চ তাদের বিয়ে হয়। ওই বছরেরই ৬ নভেম্বর বিচ্ছেদ হয় তাদের। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার কারণে পলাশকে তালাক দেন বলে জানান সিমলা।

রোববার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় সেনা কমান্ডো অভিযানে এক যুবক নিহত হওয়ার পর থেকেই তার পরিচয় নিশ্চিত হতে একাধিক সংস্থা তদন্ত শুরু করে। গতকাল সকালে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে নিহত যুবকের ছবি দেখে পলাশের লাশ হিসেবে শনাক্ত করে তার পরিবার। র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চট্টগ্রামে নিহত যুবকের আঙুলের ছাপ র‌্যাবের ক্রিমিনাল ডাটাবেজে সংরক্ষিত এক অপরাধীর সঙ্গে মিলেছে। যার সঙ্গে মিলেছে তার নাম আগের দিন দেশ-বিদেশে মাহাদী নামে প্রচারিত হলেও মূলত সে নারায়ণগঞ্জের পলাশ আহমেদ। যার বর্তমান বয়স ২৪ বছর ১১ মাস ১১ দিন। সাত বছর আগে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ পলাশ ১৭ বছরের এক কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগে র‌্যাব-১১ এর হাতে গ্রেফতার হয়। সে সময় নেমরা মারমা নামে পলাশের এক সহযোগীও গ্রেফতার হয়। ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর ১৫ দিন। পলাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এক কিশোরীকে অপহরণের পর সে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পলাশের বাবা বলেন, কাঁচপুরের এক মেয়ের সঙ্গে পলাশের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে ওই মেয়ের পরিবার পলাশের বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় সে গ্রেফতার হয়ে ২০ দিন কারাগারে ছিল। এরপর জামিনে বেরিয়ে আসে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, যে কোনো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে কেউ গ্রেফতার হলেই তার আঙুলের ছাপ ও অন্যান্য তথ্য র‌্যাবের ডাটাবেজে রাখা হয়। ওই ডাটাবেজ বিশ্নেষণ করেই প্রথমে পলাশের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। অপহরণের অভিযোগ ছাড়া অন্য কোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে পলাশের জড়িত থাকার তথ্য র‌্যাবের ডাটাবেজে নেই। বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করলে তার ব্যাপারে আরও তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। ২০১৭ সালে ওই যুবক পাসপোর্ট তৈরি করেছিল।

যাত্রীদের কেউ কেউ দেশি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বিমান ছিনতাই চেষ্টার সময় ওই যুবকের কাছে ‘বোমাসদৃশ’ বস্তু দেখার কথা বলেছেন। রোববার ঘটনার পর ঢাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান সাংবাদিকদের বলেন, কথিত ছিনতাইকারী অভিযানে নিহত হয়েছে। তার হাতে অস্ত্র ছিল। শরীরে তার বাঁধা ছিল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, বোমাসদৃশ বস্তু পাওয়ার যে জনশ্রুতি ছিল, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভুল প্রমাণিত হয়েছে। র‌্যাবের একটি বিশেষজ্ঞ দল ওই যুবকের শরীরে পাওয়া বস্তু পরীক্ষা করে। সেখানে বোমাজাতীয় কোনো বস্তু থাকার তথ্য মেলেনি।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী যুবকের হাতের অস্ত্র খেলনা ছিল কি-না তা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলা হয়নি। গতকাল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মুহিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ওই যুবকের হাতে যে পিস্তলটি ছিল সেটি খেলনা নাকি অস্ত্র তা এখনও নিশ্চিত নই। তদন্তের পর তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে সিসিটিভি দেখে বোঝা গেছে ওই যাত্রীর চেকিংয়ে পিস্তলসদৃশ কোনো বস্তু ধরা পড়েনি। গুলিবিনিময় হয়েছে কি-না তাও নিশ্চিত নই।

পলাশ মানসিক ভারসাম্যহীন? :বিমান ছিনতাই চেষ্টাকালে ওই যুবক বারবার প্রধানমন্ত্রী ও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। সে পিস্তল দেখিয়ে ক্রুকে বলছিল, বিমান ছিনতাই করতে চায়। রাতে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিমানে যারা ওই যুবকের সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের ওই যুবককে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হয়েছে।’ তবে এ ব্যাপারে পলাশের বাবা পিয়ার জাহান সমকালকে বলেন, ছেলের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কোনো তথ্য তার জানা নেই। ছেলের সঙ্গে তাদের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। সর্বশেষ যখন পলাশ বাড়িতে গিয়েছিল তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখেন তারা। আগে নামাজ না পড়লেও তখন নিয়মিত নামাজ পড়ত পলাশ। এটাকে ছেলের সুপথে ফেরার লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন তারা।

এদিকে পলাশের ফেসবুক প্রোফাইলে নায়িকা সিমলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বেশকিছু ছবি রয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি সিমলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু স্টিল ছবি দিয়ে তৈরি ভিডিও পোস্ট করে পলাশ লিখেছে ‘জাস্ট সি ইউ সুন’। এর আগে গত বছরের ১২ অক্টোবর লন্ডন ভ্রমণের চেকইন দিয়ে স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘গুড বাই বাংলাদেশ। সরি ফর সাম পার্সন। ব্যাক সুন, ফরগিভ মি।’ মাহিবি জাহান নামের ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোববার দুপুর ১টা ৩ মিনিটে সর্বশেষ স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। সেখানে সে লিখেছে ‘ঘৃণা নিঃশ্বাসে প্রশ্বাস’।

পলাশের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বিশ্নেষণ করলে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার লক্ষণ দেখা যায়। ফেসবুকে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তোলা ছবি পোস্ট করেছে। পরিবারের কোনো সদস্য বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কোনো সম্পৃক্ততা দেখা যায়নি।

মামলা : বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগে নিহত পলাশসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন ও বিমান নিরাপত্তা আইনে গতকাল রাতে মামলা করা হয়েছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানায় সিভিল এভিয়েশন এ মামলা দায়ের করে। গতকাল রাতেই পতেঙ্গা পুলিশের একটি দল আনুষ্ঠানিকভাবে লাশ শনাক্তের জন্য পলাশের বাবাকে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, কমান্ডো অভিযানে নিহত যুবক বোমাসদৃশ বস্তু ও অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। তার দাবিদাওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীকে শোনানোর জন্য বিমানের ক্রুদের বলেন। একপর্যায়ে পটকা-জাতীয় বস্তুর বিস্ম্ফোরণ ঘটান।

ঢাকা থেকে দুবাইগামী বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজ রোববার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস ঘটনার পর ‘কম্বিং অপারেশনে’র মধ্য দিয়ে ছিনতাই চেষ্টার অবসান হয়। কমান্ডো অভিযানে উড়োজাহাজে থাকা অস্ত্রধারী যুবক ‘মাহাদী’ নিহত হয়। টিকিটে তার নাম ‘মো. মাজিদুল’ বলে জানানো হয়। পরে গতকাল নিশ্চিত হওয়া যায় গোটা দুনিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টিকারী ওই যুবকের আসল পরিচয়। তবে এখনও অনেক রহস্যের জট খোলেনি। তার হাতে থাকা অস্ত্র নিয়ে গতকাল কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়।

Pin It