করোনা মহামারীর ধাক্কায় বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমে গেছে। চলতি বছরজুড়েই এই দাম কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক, অক্টোবর ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ পূর্ভাবাস দেয়া হয়েছে। তবে সে অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব তো পড়েনি বরং দাম বেড়েছে বেশির ভাগ পণ্যের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার দুষ্টচক্রের কাছে জিম্মি। ভোক্তাদের জিম্মি করে এসব দুষ্টু ব্যবসায়ী নানা ধরনের সুবিধা নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতার সুযোগে বাজারে এই চক্রের আধিপত্য ক্রমেই বাড়ছে। তারা বিভিন্ন সময়ে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে ফায়দা লুটছে। তাই বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমার পরও এর সুফল পাচ্ছে না দেশের সাধারণ জনগণ।
আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজার ব্যবস্থায় কিছু ভুল আছে। বড় পাইকারদের নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রতিযোগিতার সম ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। বাজারের ওপর প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ কমালে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এগুলো শুধরে নিলেই বাজার স্বাভাবিক গতিতে চলবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারীর কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক কার্যক্রম হঠাৎ থমকে যাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জ্বালানি ও ধাতবপণ্যের বাজার। সেই সঙ্গে মন্দার কবলে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। জ্বালানি তেলসহ পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর দাম সবচেয়ে কমেছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে কৃষিপণ্যে মাঝারি ধরনের প্রভাবের পূর্বাভাস দিলেও সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এবং আমদানিনির্ভর হওয়ায় অনেক দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইকুইটেবল গ্রোথ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইন্সটিটিউশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সেয়লা পেইজিবাসিওগলু বলেন, মহামারীর কারণে চাহিদা কমে গেছে এবং সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকরা মহামারীর কারণে নেয়া সহায়তামূলক ব্যয়ের জন্য জ্বালানি ভর্তুকি সংস্কারের মাধ্যমে তেলের কম দামের সুবিধা নিতে পারেন। তাদের অবশ্যই বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে- এমন ব্যবস্থা আরোপের আহ্বানকে প্রতিহত করতে হবে। কারণ দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেক কমেছে। এপ্রিলে তেলের দামে ঐতিহাসিক পতন হয়। প্রথমবারের মতো মার্কিন বাজারে তেলের দাম ঋণাত্মক হয়। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, চলতি বছর অপরিশোধিত তেলের দাম গড়ে ৪১ ডলার থাকতে পারে, যা ২০২১ সালে বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৪৪ ডলারে দাঁড়াতে পারে। সামগ্রিকভাবে জ্বালানির দাম (এর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা অন্তর্ভুক্ত) ২০২০ সালে গড়ে ৪০ শতাংশ কমবে। তবে ২০২১ সালে আবার বড় আকারেই ঘুরে দাঁড়াবে। ২০২০ সালজুড়ে ধাতবপণ্যের দাম ১৩ শতাংশ কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাহিদা কমার পাশাপাশি অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এটি হবে। পরিবহন খরচ কমে আসায় কৃষিপণ্যের দাম কম হবে।
বিশ্বব্যাংকের ইনফ্রাস্টাকচার বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাখতার দায়প বলেন, পণ্যবাজারে ও তেলের স্বল্পদামের বিরাট ধাক্কা উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। ভোক্তাদের জিম্মি করে এসব দুষ্টু ব্যবসায়ী নানা ধরনের সুবিধা নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বলতার সুযোগে বাজারে এই চক্রের আধিপত্য চলছেই। তারা বিভিন্ন সময়ে পণ্যের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ফায়দা লুটছে। তাই বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমার পরও এর সুফল পাচ্ছেন না দেশের সাধারণ জনগণ।
এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে বাজারে অসাধু সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট রোধে প্রতিযোগিতামূলক আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি বাস্তবতার ভিত্তিতে টিসিবিকে কার্যকর করা, গণপরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনা এবং দ্রব্যমূল্য জনগণের হাতের নাগালে রাখতে জাতীয় মূল্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশে।