চুক্তি সইয়ের সাত বছর পর চালু হলো ‘বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল’ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। বর্তমানে কেন্দ্রটির স্টিম টারবাইন ইউনিট (কম্বাইন্ড সাইকেল-১১৭ মেগাওয়াট) পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হতে পারে। ২১৮ মেগাওয়াটের গ্যাস টারবাইন (সিম্পল সাইকেল) ইউনিট ২০১৮ সালের মে মাসে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে। দীর্ঘ বিলম্বে চালু হলেও জ্বালানি সংকটের কারণে কেন্দ্রটি সবসময় উৎপাদনে থাকতে পারবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সূত্র জানায়, পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে প্রতিদিন কেন্দ্রটির ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময়ই গত কয়েকদিন ধরে এই কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে পাশের আরেকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে।
এই কেন্দ্রটির মালিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)। সিদ্ধিরগঞ্জের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ইজিসিবির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৯৮৭ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। নারায়ণগঞ্জের হরিপুরে ৪১২ মেগাওয়াট এবং সিদ্ধিরগঞ্জে ২৪০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ইজিসিবির।
৯.২৪ একর জায়গায় নির্মিত তিন হাজার ৯৭১ কোটি টাকার এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দুই হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। সরকারের বিনিয়োগ ৫৪০ কোটি কোটি টাকা। ইজিসিবির বিনিয়োগ ৪৮৯ কোটি টাকা। এই কেন্দ্র প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ হবে দুই টাকা ৩২ পয়সা।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি কিলোওয়াটে ব্যয় ৯৬১ ডলার, যা বিশ্বে বর্তমান সময়ে নির্মিত একই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। আইএমইডির প্রতিবেদন মতে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডমিনিয়ন ভার্জিনিয়া পাওয়ার প্লান্টে। এর প্রতি কিলোওয়াটের জন্য ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র পাকিস্তানের সিন্ধু ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট। যার প্রতি কিলোওয়াটের খরচ ৮৫৪ ডলার।
২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটি একনেকে অনুমোদন পাওয়া সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫ মেগাওয়াট প্রকল্পটি নির্মাণে ২০১২ সালে স্পেনের আইসোলাক্স ইঞ্জিনিরিয়া এস এবং স্যামসাং সি অ্যান্ডটি গ্রুপের সঙ্গে ইজিসিবির চুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে ২০১৪ সালের মার্চে সিম্পল সাইকেল উৎপাদনে আসার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদারি কোম্পানির গাফিলতিতে কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও কাজ হয়নি। পরবর্তীতে আইসোলাক্স ঠিকাদারির কাজ ছেড়ে চলে যায়। পরে অপর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যায়।
গতকাল শনিবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই প্রকল্পটি নির্মাণ কাজ প্রথম থেকেই বিলম্ব হচ্ছিল। প্রথম ঠিকাদার ছিল ইউরোপের। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় ওই ঠিকাদারের পক্ষে কাজ করা খুব কঠিন ছিল। পরে ঠিকাদার পরিবর্তন করা হয়। এটা করতেই দুই বছর সময় চলে যায়। ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যয় বেশি হলেও এটি দেশের সর্বাধুনিক কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট। বর্তমানে গ্যাসের যে প্রেশার আছে, তা ধরে রাখতে পারলে খুব সাশ্রয়ী দামে এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
গ্যাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, দু-একদিনের মধ্যে জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে বৈঠক হবে। ইজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরুণ কুমার সাহা বলেন, তিতাস গ্যাস তাদের গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে। পাইপ লাইনের কাজ চলছে। সেটি সম্পূর্ণ হলে এলএনজির সরবরাহ বাড়বে তখন গ্যাস দেওয়া সম্ভব হবে।
নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের আরও বলেন, বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে ২০২১ সালের মধ্যে সব রেন্টাল কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দেওয়া হবে। কেন্দ্র পরিদর্শনকালে তিনি কর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন। এর আগে নসরুল হামিদ সিদ্ধিরগঞ্জে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেন।