স্বাস্থ্য অবকাঠামো তুলনামূলক ভালো হওয়া সত্ত্বেও দেশের সব মানুষের জন্য এখনও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে না সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রাপ্তিতে নানামুখী সংকট রয়েছে সরকারি হাসপাতালে। এ কারণে মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে রয়েছে। এ অবস্থায় দরিদ্র থেকে বিত্তবান সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নূ্যনতম মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্থাৎ ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে থাকা কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল এবং নগরাঞ্চলে থাকা নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নগর প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ডেলিভারি সার্ভিসেস প্রজেক্ট এবং মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সরকারিভাবে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি এখনও। তবে জাতিসংঘ ঘোষিত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’
এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সমতা ও সংহতি নির্ভর সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা’। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় একশ’ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে এবং তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে চার কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে এবং প্রতি বছর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের হিসাব অনুযায়ী, যে কোনো পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য ৬৭ শতাংশ ব্যয় ব্যবহারকারীর নিজেরই বহন করতে হয়। সরকার ২৬ শতাংশ এবং এনজিও, প্রাইভেট সেক্টর ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি অবশিষ্ট ব্যয় বহন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘টাকার অঙ্কে বড় হলেও প্রতি বছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। চলতি বছর মোট বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারিভাবে ৩৭ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন ৮৫ থেকে ১১২ ডলার। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবার জন্য ৬১ ডলার, থাইল্যান্ড ২৮৫ ডলার, মালয়েশিয়া ৪১০ ডলার ব্যয় করে। বাংলাদেশের আশপাশে নেপালে ৩৬ ডলার এবং পাকিস্তানে ৩৯ ডলার ব্যয় করা হয়। এ বিষয়ে সরকারকে চিন্তা করতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, দেশের সমস্ত জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০১২ সালে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ কর্মসূচি চালু করা হয়। ২০১২ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে সমস্ত জনগোষ্ঠীকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত পাঁচ বছর ধরে এই কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ডা. শাহাদত হোসেন মাহমুদ বলেন, ‘২০১২ সালে বলা হলেও কর্মসূচিটি মূলত চালু করা হয় ২০১৫ সালে। সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনটি ক্যাটাগরি করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার একটি রোডম্যাপ হাতে নেওয়া হয়। এর প্রথম ধাপ ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এরই অংশ হিসেবে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের আওতায় টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে চালু করা হয় পাইলট প্রকল্প। এটি সফল হলে ধাপে ধাপে সারাদেশে এই প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণও করা হয়। কিন্তু ওই প্রকল্পের যে ধরনের অগ্রগতি প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তেমন হয়নি। কর্মসূচি মূল্যায়ন করা হয়নি এখনও। মূল্যায়ন করে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
কর্মসূচি সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে মহাপরিচালক বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের মারাত্মক সংকট রয়েছে। যেসব দরিদ্র মানুষকে হেলথ কার্ড দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে নির্ধারিত হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক না থাকায় সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। এ কারণে ধীরে ধীরে তারা সরকারি হাসপাতাল বিমুখ হয়ে পড়েছে। তবে চিকিৎসক, নার্সসহ সরকারি হাসপাতালে জনবল সংকট দূর করতে পারলে এই কর্মসূচি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।’
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা গত কয়েক বছরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিনামূল্যে ওষুধ, পথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলকে অন্যান্য দেশকে গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন পদে জনবল সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হবে। সরকার সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে।’
কর্মসূচি: দিবসটি উপলক্ষে আজ রোববার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া সারাদেশে বিভাগ থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ নানা সচেনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হবে।