শুধু ‘হার্ট অ্যাটাক’য়ের কারণে বুকের বাম পাশে ব্যথা হয় না।
ভোঁতা, তীক্ষ্ণ বা চাপ ধরা- অনুভূতি যেমনই হোক, বুকে বা নারীদের ক্ষেত্রে স্তনের তলার দিকে ব্যথা হওয়ার বিষয়কে মোটেই অবহেলা করা যাবে না।
আর সার্বিকভাবেই বুকে ব্যথা হওয়া স্বাস্থ্য সমস্যাকে ইঙ্গিত করে।
এই তথ্য জানিয়ে ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ক্যালিফোর্নিয়া’র সান্টা মনিকাতে অবস্থিত ‘প্রোভিডেন্স সেইন্ট জন’স মেডিকেল সেন্টার’য়ের চিকিৎসক ডেভিড কাটলার বলেন, “বুকের সব ব্যথা ‘হার্টঅ্যাটাক’ নির্দেশ করে না। অন্য কোনো আঘাত, হজম সমস্যা, হৃদপিণ্ডের অসুস্থতা, রক্ত প্রবাহে গণ্ডগোল এমন নানান করণে বুকের বাঁ দিকে ব্যথা হতে পারে।”
আট রকমের কারণে বাঁ বুকে বা স্তনের তলায় ব্যথা করতে পারে।
আঘাত
সম্প্রতি উল্টে পড়ে গিয়ে পাঁজরে আঘাত পেয়ে থাকলে, হতে পারে বুকে ব্যথা।
ডা. কাটলার বলেন, “বুকের দেয়ালে থাকা মাংস পেশি ফুলে যাওয়া, টান পড়া বা বেকায়দায় থাকলে সেখানে ব্যথা করতে পারে।”
সমাধান: বুকের পেশিতে হালকা ব্যথা হলে সময়ের সাথে সেটা সেরে যায়। এক্ষেত্রে আরাম পেতে গরম ভাপ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে পাঁজরে কোনো ফাঁটল আছে কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতে পারে।
কস্টোকনড্রাইটিস
বাম দিকে স্তনের হাড়ে সুক্ষ্ম, চেপে ধরা ব্যথা, গভীর নিঃশ্বাসে বা কাশলে অবস্থা আরও খারাপ হয়- এরকম অবস্থাকে বলা হয় ‘কস্টোকনড্রাইটিস’।
ডা. কাটলার ব্যাখ্যা করেন, “স্তনের হাড় ও পাঁজরের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী তরুণাস্থির প্রদাহের কারণে এরকম হয়। আর সাধারণত বয়সের চল্লিশের পরে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।”
সমাধান: এক্ষেত্রে পেশাদার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। ব্যথা কমানোর ওষুধসহ নানান ধরেনর সেবার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব।
হজমতন্ত্রে সমস্যা
পেটের সমস্যা থেকেও বুকে ব্যথা হতে পারে। এরকম কয়েকটি সমস্যার মধ্যে রয়েছে-
অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা জিইআরডি: পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালী দিয়ে উঠে আসলে এই সমস্যা হয়। ফলে বুকেও ব্যথা হতে পারে। অ্যান্টাসিড-ধর্মী ওষুধে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া অতিরিক্ত খাওয়া, তেলেভাজা মসলাদার খাবার, অ্যালকোহল সেবন, ধূমপান এড়াতে হবে। কারও কারও ক্ষেত্রে ডাল ও বীজ ধরনের খাবার থেকেও সমস্যা হয়। এরকম হলে সেগুলো চিহ্নিত করে খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
গ্যাস্ট্রাইটিস: বা পাকস্থলীর ভেতরের আবরণে প্রদাহ। যা থেকে পেটে ব্যথা হয়। সেখান থেকে বুক বা স্তনের নিচে ব্যথা হতে পারে। চিকিৎসক কারণ বের করে চিকিৎসা দিতে পারবেন। ঘরোয়া কোনো প্রতিকার নেই।
হিয়াটল হার্নিয়া: যখন পাকস্থলীর ওপরের অংশটি বুক এবং পেটকে স্ফীত ও বিস্তৃতি পেশি দিয়ে আলাদা করে ফেলে তখন এই অবস্থার তৈরি হয়। ফলে অস্বস্তি বা ব্যথা হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে সবসময় দরকার হয় না, তবে ‘হার্টবার্ন’য়ের ওষুধ দিতে পারেন চিকিৎসকরা। এতেও সমস্যা না মিটলে হার্নিয়া অপারেশন’য়ের প্রয়োজন পড়বে।
স্তনের অবস্থা
নারীদের ক্ষেত্রে স্তনের চারপাশে ও নিচে ব্যথা হওয়ার নানান কারণ থাকতে পারে।
ম্যাসটাইটিস: যা কিনা স্তন কোষ সম্বন্ধীয় ব্যথা হিসেবে পরিচিত। স্তনদানকারী মায়েদের এমন সমস্যায় হয় দুধ আটকে গেলে।
জনস হপকিন্স মেডিসিন’য়ের তথ্যানুসারে- এরফলে উষ্ণভাব, লালচে ও ফুলে যেতে আর ফ্লু হলে যেমন ব্যথা করে তেমন অনুভূত হয়।
সমাধান: অবশ্যই ধাত্রী ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের শরাণাপন্ন হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হবে।
ফাইব্রোসিস্টিক ব্রেস্ট: মাসিক চলার সময় নারীদের সারা শরীরে হরমোনের ওঠানামা চলে। বিশেষ করে ৩০ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে যাদের বয়স। এর ফলে স্তনে পিণ্ডর মতো ফোলা অথবা দড়ির মতো রেখা ফুটে উঠতে পারে, বিশেষ করে মাসিক শুরুর আগ সময়ে। এটার জন্য বুকে বা স্তনে ব্যথাও হয়।
সমাধান: এটা ক্ষতিকর নয়। আর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ায় না- জানান ডা. কাটলার। তবে কোনো পিণ্ড বা দলা কিংবা ফোলাভাব হলে অর্থাৎ স্তনে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্তন ক্যান্সার: খুবই অস্বাভাবিক বা সচারচর দেখা যায় না, তারপরও স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে বুকে ব্যথা। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- স্তনে বা বগলে পিণ্ড হওয়া, স্তনের চারপাশ ফুলে ওঠা বা পুরু হওয়া, বুকের ত্বকে টোল পড়া ও অস্বস্তিভাব, স্তনাগ্রে লালচে ভাব বা স্তর পড়া, রস নিঃসরণ বা স্তনের আকারের পরিবর্তন।
সমাধান: “এসব লক্ষণ থাকলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে যত আগে চিকিৎসা শুরু করা যাবে ততই মঙ্গল”- বলেন ডা. কাটলার।
স্নায়ুর সমস্যা
কোনো কোনো নির্দিষ্ট কোনো স্নায়ুগত সমস্যা থেকে বুকে বা স্তনে ব্যথা হতে পারে।
থোরাসিস নিউরালজিয়া: “যখন পিঠের কোনো স্নায়ু সুক্ষ্মভাবে খোঁচা দেয় তখন বুকে সুক্ষ্ম বা কেউ ছুরি চালাচ্ছে এমন অনুভূতি হয়” বলেন ডা. কাটলার।
সমাধান: বুকে বা পিঠে কোনো আঘাত পেলে এমন হতে পারে। নানান ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়ে।
শিঙ্গলজ: যদি চিকেনপক্স বা জলবসন্তে শিকার হলে, ভালো হওয়ার পরও ভাইরাস আবার উদ্ভুদ হতে পারে ফুসকুড়ির আকারে। বিশেষ করে বয়স পঞ্চাশের পরে গেলে। এরপলে ত্বকের তলায় থাকা স্নায়ুতে প্রদাহ হয়। যেখানে থেকে জ্বালা, ব্যথা প্যাঁচানোর মতো অনুভূতি হতে পারে।
ডা. কাটলার বলেন, “যদি ভাইরার বুকের অংশে আক্রমণ করে তবে ব্যথা ও জ্বালাভাব অনুভূত হয়।
সমাধান: ডাক্তারকে জানাতে হবে ফুসকুড়ি উঠছে এবং একসময় জলবসন্ত হয়েছিল। এর কোনো চিকিৎসা না থাকলেও ‘অ্যান্টিভাইরাল’ ওষুধ দিয়ে দ্রুত উপশম সম্ভব।
ফুসফুসের সমস্যা
বিভিন্ন ধরনের ফুসফুসের রোগ থেকেও বুকে ব্যথা হতে পারে।
ফুসফুসে সংক্রমণ: ‘আমেরিকান লাং অ্যাসোসিয়েশন’য়ের তথ্যানুসারে নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিস থেকে সুক্ষ্ম ও ছুরি চালানোর মতো ব্যথা বুকে হয়। বিশেষ করে গভীর শ্বাস নিলে ব্যথা বেশি অনুভূত হয়। সাথে থাকবে জ্বর, নিঃশ্বাসে সমস্যা, ক্লান্তি।
প্লুরেসি: ফুসফুসে আবরণে ‘অটোইমিউন’ রোগ থেকে সংক্রমণ হয়। যে কারণে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হতে পারে বুকে।
সমাধান: কারণ বের করে চিকিৎসা নিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকে সেরে যায়। তবে ডাক্তারই সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন।
হৃদ সমস্যা
ডা. কাটলার বলেন, “বুক বা স্তনে বিশেষ করে বাম পাশে ব্যথা হওয়ার কারণ হতে পারে হৃদপিণ্ডের নানান সমস্যা।”
অ্যাঞ্জাইনা: এই অবস্থায় সাময়িকভাবে হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ কমে যায় তখন বুকে ব্যথা হয়। মনে হয় ‘হার্ট অ্যাটাক’ হচ্ছে।
ডা. কাটলার বলেন, “হার্ট অ্যাটাক’য়ের মতো এটাও এক ধরনের হৃদপিণ্ডের রোগ।”
সমাধান: বিশ্রাম বা ওষুধের মাধ্যমে সারানো যায়। এছাড়া জীবনযাত্রা পরিবর্তন, রক্তচাপের ওষুধ, বা কোলেস্টেরল কমানোতে সমস্যা সমাধান করা যায়। হঠাৎ এই ধরনের ব্যথা হলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া জরুরি।
হৃদপিণ্ডে সংক্রমণ: ‘পেরিকর্ডাইটিস’ বা ‘এন্ডোকার্ডাইটিস’য়ের মতো সমস্যা হয় যখন হৃদপিণ্ডের কোনো অংশ স্ফীত হয়। ভাইরাসের আক্রমণ বা নিউমনিয়া থেকে এরকম হতে পারে। সুক্ষ্ম ও ছুরি চালনার মতো ব্যথা হয় পেটের উপরিভাগ থেকে স্তনের নিচ পর্যন্ত।
সমাধান: রোগের ধরন বুঝে চিকিৎসক সারানোর ব্যবস্থা করবেন। দরকার হতে পারে উচ্চ মাত্রার ‘অ্যান্টি-ইনফ্লামাটরি’ ওষুধ।
হার্ট অ্যাটাক: হৃদপিণ্ডের ধমনিতে রক্ত জমাট বেধে আটকে গেলে এই অবস্থা তৈরি হয়।
ডা. কাটলার বলেন, “এই অবস্থায় অসহ্য ব্যথা অনুভূত হয় বুকে বাম দিকে, হাতে ঘাড়ে এবং চোয়ালে। এছাড়া বুকে চাপ ধরাভাব, ক্লান্তি, ঠাণ্ডা ঘাম, মাথা ঝিমঝিম, বমিভাব, নিঃশ্বাসে সমস্যা থাকবে।”
সমাধান: জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।