যেমনটা ভাবা হচ্ছিল তাই ঘটল; ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে বড় ধরনের হার হল যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মের।
পাঁচ দিন ধরে আলোচনার পর মঙ্গলবার রাতে যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ হাউস অব কমন্সে ভোটের এই ফলে অর্ধ শতকের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়া দেশটির অনিশ্চয়তা আরও বাড়াল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের পথরেখার যে পরিকল্পনা টেরিজা মে পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেছিলেন, ৬৫০ সদস্যের পার্লামেন্টে তা ৪৩২-২০২ ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
টেরিজার রক্ষণশীল দলের অনেকে বিপক্ষে ভোট দেন; লেবার পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের এমপিরা তো ছিলেনই।
ভোটের ফলের পর লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, এটা সরকারের জন্য বিপর্যয়কর পরাজয়।
এখন টেরিজার সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে, একটি হল তিন দিনের মধ্যে পার্লামেন্টে নতুন আরেকটি চুক্তির খসড়া তোলা, অন্যটি হচ্ছে ইইউর দেওয়া চূড়ান্ত সময়সীমা ২৯ মার্চ থেকে আবার বাড়িয়ে নেওয়া।
আর তা না হলে আগামী ২৯ মার্চ এক রাতেই ইউরোপের ২৭টি দেশের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে হবে যুক্তরাজ্যকে।
২০১৬ সালের ২৩ জুন যুক্তরাজ্যে এক গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির চার দশকের সম্পর্কোচ্ছেদের রায় হয়।
অন্যদিকে ৪৮ শতাংশের ভোট ছিল ইউরোপের আরও ২৭টি দেশের জোটে থেকে যাওয়ার। ওই ভোটে হারের পর তারা পুনরায় গণভোটের দাবিও তুলেছিল, তবে তা ঘটেনি।
আড়াই বছর আগের ওই গণভোট ছিল সম্পর্ক ছিন্নের আনুষ্ঠানিকতার শুরু। ভোটে হারের পর রক্ষণশীল দলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করলে টেরিজা মে সেই দায়িত্ব নিয়ে বিচ্ছিন্নতার পথরেখা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই জোট থেকে কোন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য আলাদা হবে এবং এরপর ইইউভুক্ত বাকি ২৭টি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হবে, সেই পথ বের করার জন্য সময় নেওয়া হয় আড়াই বছর।
আগামী ২৯ মার্চ সেই সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার আগে যুক্তরাজ্যকে তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হচ্ছে, সে লক্ষ্যে ইইউর সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করা চুক্তি নিয়ে মঙ্গলবার পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে ভোটাভুটিতে যেতে হয় টেরিজা মেকে।
এই ব্রেক্সিট চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল জোট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যুক্তরাজ্য ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেবে; সম্পর্কোচ্ছেদের পর যুক্তরাজ্যে বসবাসরত জোটের অন্য দেশগুলোর ৩২ লাখ নাগরিকের ভবিষ্যৎ কী হবে কিংবা ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে বসবাসরত যুক্তরাজ্যের ১৩ লাখ নাগরিকের সুযোগ-সুবিধার কী পরিবর্তন ঘটবে; যুক্তরাজ্যভুক্ত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং ইইউতে থেকে যাওয়া আয়ারল্যান্ডকে আলাদা করতে আবার কীভাবে সীমান্ত তুলতে হবে, তার মীমাংসা করা।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউভুক্ত বাকি ২৭টি রাষ্ট্রের নতুন সম্পর্ক কী রূপে হবে এবং আন্তঃবাণিজ্যের বিষয়গুলো কেমন হবে, তাও চুক্তির আলোচ্য।
যুক্তরাজ্য চুক্তি পার্লামেন্টে অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার পর ২৯ মার্চ থেকে শুরু হবে ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণের কাজ; তার জন্য ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ সময় রয়েছে।
কিন্তু যদি কোনো চুক্তি ছাড়াই যুক্তরাজ্যকে ইইউ ছাড়তে হয়, সেটা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ তাহলে ২৯ মার্চের পর আর অন্তর্বর্তীকালীন সময় থাকবে না। তখন থেকেই যুক্তরাজ্যের জন্য ইইউর সব নিয়ম-কানুন অকার্যকর হয়ে যাবে; এক রাতেই ইউরোপের ২৭টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
টেরিজা মে যে খসড়া চুক্তিটি ৬৫০ সদস্যের পার্লামেন্টে তুলেছিলেন; তার বিরোধীরা বলছিল, এই চুক্তিতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি, যুক্তরাজ্যের নিজস্ব বিষয়ে ইইউকে ছাড়িয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব ফুটে ওঠেনি।
গত নভেম্বরে ব্রেক্সিটমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো ডমিনিক র্যাবের মতে, কোনো চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হয়েছে।
ভোটাভুটির আগে তিনি বিবিসি রেডিওকে বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় ব্রেক্সিটের কথা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং আমরা এই বিষয়ে হাত তুলে বসে থাকবো না; ভোটের মাধ্যমে আমরা এটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেব, এবার আমাদের পালা।”
প্রধানমন্ত্রীর দল কনজারভেটিভ পার্টির অনেক এমপি’র মতে, খসড়া চুক্তিতে ব্রাসেলসের হাতে ‘অতিরিক্ত ক্ষমতা’ তুলে দেওয়া হয়েছে।
দলের মধ্যে ভোটাভুটিতে কোনোমতে জেতার পর অন্য দলগুলোর সমর্থন পেতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন টেরিজা; তিনি এবং ইইউ নেতারা খসড়া চুক্তির কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের আশ্বাসও দিয়েছিলেন।
পার্লামেন্টে ভোটের ফলাফল বিপক্ষে গেলে প্রতিপক্ষ লেবার পার্টি পুরো প্রক্রিয়াটি জবরদখল করতে পারে বলেও নিজেদর দলের এমপিদের সতর্ক করেছিলেন টেরিজা।
কিন্তু তারপরও এই চুক্তির বিরোধী এমপিদের মন গলেনি। সোমবার রাতে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউজ অব লর্ডসে চুক্তিটি ৩২১-১৫২ ভোটে বড় ধরনের পরাজয়ের পর নিম্নকক্ষে ভোটাভুটিতেও চুক্তিটি পাস করিয়ে আনতে পারেননি টেরিজা মে।
পার্লামেন্টে ভোটে প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যাওয়া টেরিজা মের ভবিষ্যতেও ফেলছে ছায়া। মঙ্গলবারের ভোটের পরপরই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের ডাক দিয়েছেন লেবার নেতা জেরেমি করবিন, যা নিয়ে বুধবার আলোচনা হবে।